Breaking

Monday 18 July 2022

সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি



 সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি 
(Rajput Policy of Akbar)

ভারতে মোগল সাম্রাজ্য কে শক্তিশালী ও স্থায়ী করার একটি অন্যতম কৌশল ছিল সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি। মুঘলরা মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল বলে তাদেরকে ভারতে আগন্তুক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাষ্ট্রপুঞ্জের পাশাপাশি ভারতে আফগান শক্তি ছিল মুঘলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। শের শাহের মৃত্যুর পর আকবরের শক্তি দুর্বল হয়ে পরলে প্রাদেশিক স্তরে আফগানরা তখনও শক্তিশালী ছিল। তাছাড়া আকবরের অধীনস্থ সেনাপতিরা তার প্রতি যথেষ্ট অনুগত ও দায়িত্বশীল ছিল না। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। আর সেই সময় রাজপুতরা ছিল ভারতের শ্রেষ্ঠ সামরিক জাতি। জাতিগতভাবে রাজপুতরা ছিল হিন্দু। তারা বীর ও স্বজাত্যবোধে সচেতন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত ছিল। তাই তিনি উপলব্ধি করেন যে মুঘল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে মুঘল প্রভুত্ব সুদৃঢ় করার জন্য রাজপুতদের সহযোগিতা ও মৈত্রীর লাভ করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই আকবর রাজপুত নীতি গ্রহণ করেন।






রাজপুত কারা?  রাজপুতদের পরিচিতি: 

ভারতের ইতিহসে  রাজপুত বলতে হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এমন একটি বীরযোদ্ধা শ্রেণীর সম্প্রদায়কে বুঝায় যারা ভারতের বিভিন্ন স্থানে বংশানুক্রমিক ভাবে শত শত বছর ধরে রাজত্ব কায়েম করেছিল। মুঘলদের ভারতবর্ষে রাজ্য স্থাপনকালীন সময়ে এদেশের অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল রাজপুত জাতি। জাতিগতভাবে রাজপুতরা ছিল হিন্দু। তারা বীর ও স্বজাত্যবোধে সচেতন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত ছিল। রাজপুতরা 6ষ্ঠ শতাব্দী থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং 20 শতকের মধ্যে মধ্য ও উত্তর ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। রাজপুত রাজ্যগুলি ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে উত্তর, পশ্চিম এবং মধ্য ভারতে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে রাজস্থান, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, বিহার এবং সিন্ধু।


রাজপুত নীতির উদ্দেশ্য

  1. রাজপুতদের সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ

  2. বিদ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে তাদের কাজে লাগানো

  3. প্রশাসনিক ভারসাম্য রক্ষা করা

  4. সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা

  5. হিন্দুদের মন জয় করে তাদের সমর্থন লাভ করা

  6. অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন


গৃহীত নীতিসমূহ: 

  1. মিলনাত্মক বা আপোষমূলক নীতি

  2. যুদ্ধংদেহী  নীতি: 


  1.  মিলনাত্মক বা আপোষমূলক নীতি


  1. বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন:

  1. আকবরের লক্ষ্য ছিল বিয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী রাজপুত গোষ্ঠীর সাথে জোট গঠন করা। তিনি 1562 সালে জয়পুরের রাজা বিহারীমলের কন্যাকে বিয়ে করেন। 1570 সালে তিনি বিকানির রাজ্যের রাজকুমারীকে বিয়ে করেন।

  2. তারপর জয়পুরের রাজা ভগবান দাসের কন্যার সঙ্গে নিজের পুত্র সেলিমের বিয়ে দেন।

  3. ডঃ বেনি প্রসাদ ভারতীয় রাজনীতিতে মুঘল-রাজপুত্র এই বিবাহ নীতি সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন যে, এটি দেশের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এভাবে একে একে মেবার ছাড়া প্রায় সব রাজ্যই আকবরের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে।


  1. উচ্চ পদে হিন্দুদের নিয়োগ:

তিনি সামরিক এবং বেসামরিক বিভাগের উচ্চ পদে রাজপুতদের নিযুক্ত করেন,এর মাধ্যমে  আকবর রাজপুতদের সর্বাত্মক সহযোগিতা লাভ করেন।যেমন-

  1. বিহারীমলের পুত্র ও পৌত্রী যথাক্রমে ভগবান দাসকে ৫ হাজারি এবং

  2. বিহারীমলের পৌত্র মান সিংহকে ৭ হাজারী মনসবদারের পদমর্যাদা দেওয়া হয়।

  3. বীরবল ছিলেন আকবরের অন্যকম সভাসদ

  4. টোডরমল কে রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগ

  5. জপুত রাজাদের আস্থা অর্জনের জন্য, তিনি গুজরাট অভিযানের সময় আগ্রার নিরাপত্তা বিহারীমালের কাছে অর্পণ করেন।

  6. এ ছাড়া রাজপুত কবি, শিল্পী, চিত্রকর তার রাজসভা অলংকৃত করেন।


  1. তীর্থ কর রহিতকরণ: 

রাজপুত সম্প্রদায় এবং হিন্দুদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য আকবর তাদের উপর থেকে তীর্থকর রহিত করেন। তীর্থস্থানে গমনের জন্য একটি কর প্রচলিত ছিল আকবর তা বাতিল করেন। 

  1. জিজিয়া কর রহিত করণ:

জিজিয়া কর হলো মুসলিম শাসনাধীনে বসবাসরত অমুসলিমদের দেওয়া নিরাপত্তা কর। এই কর দেয়ার মাধ্যমে তারা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করা থেকে অব্যাহতি পে এবং সর্বপ্রকার রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নিরাপত্তা লাভ করত। আকবর এই জিজিয়া কর বাতিল করেন । 

  1. শিক্ষা ব্যবস্থায় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান: 

আকবর হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার জন্য বেশ উদার ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। 

  1. সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু  দিনে পশু জবাই নিষিদ্ধকরণ  এবং গো হত্যা বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ।

  2. এছাড়া বাল্যবিবাহ শিশু হত্যা সতীদাহ প্রথা ও বর্ণবৈষম্যের বিলুপ্তি সাধন বিধবা বিবাহের প্রচলনের চেষ্টা করেন । 

  3. হিন্দুদের আচার-অনুষ্ঠানে  তিনি নিজে অংশগ্রহণ। 


তীর্থকর, জিজিয়া প্রভৃতি বৈষম্যমূলক করের অবসান, সর্বধর্ম-সহিষ্ণুতা প্রদর্শন, হিন্দু মন্দির নির্মা, হিন্দুদের উৎসব পালনের স্বাধীনতার প্রদান, হিন্দু সমাজের হিন্দু সমাজের কুপ্রথা দূরীকরণের চেষ্টা, হিন্দু সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা, হিন্দুদেরকে উচ্চ রাজকর্মচারী পদে নিয়োগ প্রভৃতি উদারনীতি অবলম্বন করে আকবর হিন্দুস্থানের প্রথম জাতীয় সম্রাট হিসেবে তাদের মনে স্থায়ী আসন লাভ করেছিলেন। 


২. যুদ্ধংদেহী  নীতি: 

যদিও আকবর রাজপুতদের প্রতি সমঝোতামূলক নীতি অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং বিদ্রোহ তিনি সহ্য করতেন না। তিনি চিতোর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। রনথম্ভোর, যোধপুর, বিকানী প্রভৃতি রাজ্য সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। রানা প্রতাপসিংহ তাঁর বশ্যতা স্বীকার না করায় হলদিঘাটের যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন। 1599 সালে, প্রতাপ সিংয়ের পুত্র অমরসিংহ পরাজিত হন এবং রাজপুত যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।


রাজপুত জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আকবরের দ্বিধা করেননি, কিন্তু পরাজিত রাজপুতদের প্রতি মিত্রতা পূর্ণ ব্যবহার করে ও উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়ে তিনি তাদের মন জয় করেছিলেন তাঁর এই সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহারের জন্য বিজিত শত্রু তার চিরতে মিত্রতে পরিণত হয়েছিল। 

 

সাম্রাজ্যবাদী সম্রাট রাজপুত জাতির স্বাধীনতা নষ্ট করেছিলেন সত্য, কিন্তু প্রকৃত সম্রাট সুলভ মহাননীতি ও জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে প্রীতি পূর্ণ ব্যবহার করে এবং বিজিত শত্রুর উপযুক্ত মর্যাদা দান করে ও তাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তিনি তাদের মনের গ্লানি দূর করে অনুগত মিত্রতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।


রাজপুত নীতির ফলাফল: 

ডঃ বেনীপ্রশাদ তার ‘হিস্টরি অফ জাহাঙ্গীর’ গ্রন্থে আকবরের রাজপুত নীতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আর মতে আকবরের রাজপুত নীতির ফলে মোঘল বংশ মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কূটনীতিবিদ ও সেনাপতিদের সহযোগিতা সহযোগিতা লাভ করতে সক্ষম হয়। 

 নিম্নে আকবরের রাজপুত নীতির ফলাফল আলোচনা করা হলো –


  1. মোগল সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণ:

এই নীতির মাধ্যমে দীর্ঘ  দিনের শত্রু রাজপুতগণ মুঘলদের বন্ধুতে পরিণত হয়। সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে যে রাজপূত্রা সংগ্রাম করে এসেছিল তারা এখন আকবরের মিত্রতে পরিণত হয়ে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ফলে রাজপুতানাতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সম্রাট আকবর রাজপুতদের সহযোগিতায় মোঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন।


  1. সামরিক বাহিনীর উন্নতি:

রাজপুত-মুঘল জোট মুঘল সেনাবাহিনীকেও শক্তিশালী করেছে। মুঘল এবং রাজপুত উভয়ের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা মুঘল সামরিক বাহিনীর একটি কৌশলী ও শক্তিধর সেনাবাহিনী পরিণত হয় । 

  1.  আর্থিক উন্নতি:

রাজপুত নীতি সাম্রাজ্যের আর্থিক উন্নতির পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়। পশ্চিম উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্য চলত রাজপুতানার মধ্য দিয়ে। রাজপুতানার ওপর মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজতর হয়। অন্যদিকে মারওয়ার দখলের পর গুজরাটের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামরিক অভিযান পরিচালনা করা সহজতর হয়। 

  1. নবযুগের সূচনা:

রাজপুত নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্রাট আকবর ভারতের হিন্দু-মুসলমানদের মাঝে এক অনন্য অসাম্প্রদায়িক বন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা ভারতীয় সাংস্কৃতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। রাজপুত বংশীয় অনেক কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী আকবরের রাজসভা অলংকৃত করেছে ।এর ফলে মোগল স্থাপত্য, শিল্প, ভাস্কর্য, সংগীত ইত্যাদিতে হিন্দু-মুসলিম ভাবধারার সমন্বয় ঘটেছে।



  1.  রাজপুতদের ওপর রাজপুত নীতির  প্রভাব:

আকবরের রাজপুত নীতির মাধ্যমে শুধু আকবর উপকৃত হয়েছিলেন তা নয় বরং রাজপুত্ররাও দারুণভাবে উপকৃত হয়েছিল। 

  1. সম্রাট আকবর রাজপুতদের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর রাজপূত্রা নিজ রাজ্যে স্বাধীনভাবেই শাসন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। 

  2. সম্রাট আকবর রাজপুতদের আনুগত্য  যোগ্যতা এবং সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ তাদেরকে বড় বড় প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেন। 



সম্রাট আকবরের রাজপুতনীতি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা প্রসূত চিন্তা-চেতনার ফসল। অসাম্প্রদায়িক ও সর্বভারতীয় সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ধর্মীয় বিধিবিধান কে উপেক্ষা করেছেন। রাজনীতিকে তিনি সবচেয়ে বড় করে দেখেছেন সেজন্য বলা হয় যে আকবর রাজনীতির জন্য ধর্মকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন।  সর্বোপরি আকবর তার  রাজপুতনীতিতে সফল হয়েছিলেন। 







No comments:

Post a Comment