১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কারণ ও ফলাফল
(Causes and results of the Sepoy Mutiny of 1857)
The Indian Revolt of 1857
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ বিদ্রোহ ছিল বিগত 100 বছরের ব্রিটিশ শাসন,শোষণ, নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। কেউ কেউ এটাকে বলেছেন নিছক সিপাহী বিদ্রোহ কেউ বলেছেন এটা জাতীয় সংগ্রাম, আবার অনেকে বলেছেন মহাবিদ্রোহ। কিন্তু এ বিদ্রোহ যে কোম্পানির শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নাই। শুধু সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসহযোগিতার কারণেই এই বিদ্রোহ সফলতা লাভ করতে পারেনি। এই বিদ্রোহের পেছনে কয়েকটি প্রত্যক্ষ কারণ থাকলেও এর পেছনে মূলত বহুবিধ পরোক্ষ কারণ বিদ্যমান ছিল। এ বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং মুক্তি সংগ্রামের পথে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কারণসমূহ
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘ ১০০ বছর কোম্পানির বিভিন্ন কর্মকান্ড বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। আমরা ঐতিহাসিকদের মতামত এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহের কারণ উদ্ঘাটন করব।
যুবরাজ মির্জা ফিরোজশাহ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পুর্বে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম কতগুলো অভিযোগ উপস্থাপন করেন এগুলো বিপ্লবের পেছনে কারণ বলে আমরা মনে করি যেমন-
ইংরেজ শাসনে এদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে দেয়া হয়েছে।
ইংরেজ শাসন এদেশের সকল ধর্মকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ভূমি শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশ নীতি এদেশের ভূমি মালিকদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
তারা এখানে একটা স্বতন্ত্র জাতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছে।
তারা সামরিক দিক দিয়ে দেশীয় সিপাহীদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ।
ভারতের মসজিদ এবং মন্দির বিনাশে তারা নিয়োজিত ছিল।
ধর্ম প্রচারে খ্রিস্টানদের অবাধ সুযোগ এবং এদেশের মৌলভী ব্রাহ্মণদের বাধা দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয়দেরকে ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে খ্রিস্টানরা তৎপর ছিল।
বিচার ব্যবস্থায় দেশীয় আইন বাতিল করে তারা ব্রিটিশ আইন প্রচলন করেছিল।
উইলিয়াম মন্টোগোমারি তার ইন্ডিয়ান এম্পায়ার গ্রন্থে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পেছনে ১৭টি কারণ উল্লেখ করেছেন যেমন-
অত্যাচারী ও শোষণমূলক নীতি;
অদক্ষ প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থা;
চাকুরীর ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বঞ্চিতকরণ;
দেশীয়দের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন;
শিক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংস্কার এবং মিশনারীদের কার্যকলাপ;
জাতিভেদ প্রথা;
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা;
মুদ্রানীতি;
একচেটিয়া বাণিজ্য;
জনকল্যাণে কোম্পানির উদাসীনতা;
ইংরেজদের কর্ম উদ্যোগের অভাব;
দেশীয় রাজ্য দখল;
হিন্দুদের উত্তরাধীকারী আইন পরিবর্তন;
স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ করে রাজ্য দখল;
দেশীয় সিপাহীদের অবমূল্যায়ন;
মুসলমানদের ষড়যন্ত্র এবং
বৈদেশিক ষড়যন্ত্র।
সমসাময়িক দার্শনিক কাল মার্কস এই বিদ্রোহের পেছনে পাঁচটি কারণকে দায়ী করেছেন। যেমন-
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন এবং এর ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা;
অত্যাচারমূলক করারোপ;
কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া;
শিল্প ব্যবস্থা ধ্বংস এবং বৃটেনের পণ্যের ভারতের বাজার দখল;
উপনিবেশিক শক্তি ও জমিদারদের নির্যাতন।
এসব কারণ ছাড়াও ইতিপূর্বে সংগঠিত আরও দুটি বিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহকে উৎসাহ দিয়ে ছিল যেমন-
মাদ্রাজে 1803 সালে রায়তওয়ারি পদ্ধতির বিরুদ্ধে ভূমি মালিকদের বিদ্রোহ এবং
উত্তর ভারতের মহারানী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
উপর্যুক্ত মন্তব্যগুলোর প্রেক্ষিতে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সিপাহী বিদ্রোহের কারণগুলোকে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি-
আরও পড়ুন-
জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর এবং ভারতে মুঘল বংশ প্রতিষ্ঠা
ক. পরোক্ষ কারণ
A. রাজনৈতিক কারণসমূহ
স্বত্ববিলোপ নীতি:
লর্ড ডালহৌসি ছিলেন চরম সাম্রাজ্যবাদী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোট অব ডিরেক্টরস প্রনীত স্বত্ববিলোপ নীতির সর্বোচ্চ প্রয়োগ করেন লর্ড ডালহৌসি। তিনি স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে ছলে-বলে-কৌশলে এদেশে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিস্তার ঘটান। স্বত্ববিলোপ নীতি প্রবর্তন করে তিনি সেতারা, ঝাসি, সম্বলপুর, উদয়পুর, আর্কোট,কাশিনগর, জয়িতপুর প্রভৃতি স্বাধীন রাজ্য দখল করে নেন। তিনি তাঞ্জোর ও কর্ণাটের রাজপরিবারের ভাতা বন্ধ করে দেন। কোন রাজার পুত্র না থাকলে তিনি সে রাজ্যগুলো দখল করে নেন। আবার যাদের পুত্র নেই তাদের দত্তকপুত্র রাখার অধিকার খর্ব করা হয়। স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে দেশীয় রাজ্যগুলি দখল করার এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে ।
অযোধ্যা দখল:
লর্ড ডালহৌসি কোন বৈধ কারণ ছাড়াই মিথ্যা অজুহাতে 1856 সালে একটি শক্তিশালী দেশীয় রাজ্য অযোধ্যা দখল করে নেন। অযোধ্যার নবাব ছিলেন ওয়াজেদ আলী। লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক অযোদ্ধা দখল সিপাহী বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করে।
সম্রাটের প্রতি অসম্মান:
তখনো মোগল সম্রাট ছিলেন ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতীক ৷ কিন্তু 1835 সালের দিকে সম্রাটের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আইন পাশ করা হয়। মুদ্রা থেকে সম্রাটের নাম বাদ দেয়া হয়। সম্রাটের কাছ থেকে খিলাত গ্রহণ করার নীতি পরিহার করা হয়। সম্রাটকে অভিবাদন না জানানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাদশাহ উপাধি পরিবর্তন করে শুধু শাহ নির্ধারণ করা হয়। ইতিপূর্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে সম্রাটের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও কোম্পানি তা বাতিল করে। এসব ছিল সম্রাটের প্রতি অসম্মানজনক যা জনতা এবং সিপাহী উভয়কে ক্ষুব্ধ করেছিল।
মুঘল সম্রাট ভারতীয় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন,শূ বরং ইংরেজরা ভারতের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে লর্ড ডালহৌসি ঘোষণা দিলে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধিতা বৃদ্ধি পায় সিপাহিদের প্রভাবিত করে।
দেশীয়দেরকে উচ্চ পদ থেকে বঞ্চিতকরণ:
লর্ড কর্নওয়ালিশের সংস্কার এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দেরকে বিশেষত মুসলমানদেরকে সরকারি উচ্চ পদ থেকে বঞ্চিত করা৷ লর্ড কর্নওয়ালিস ভারতীয় মুসলিম ও অমুসলিমদেরকে উচ্চ পদ থেকে বঞ্চিত করার পক্ষপাতী ছিলেন। তখনো ব্রিটিশ প্রশাসনে কিছু হিন্দু নিয়োগ পেলেও বড় বড় পদে ভারতীয়দেরকে নিয়োগ দেয়া হতো না। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোম্পানির এইরকম নীতির কারণে ভারতীয় বিশেষ করে মুসলিমরা ক্ষুব্ধ ছিল।
ইংরেজ কর্মচারীদের অত্যাচার:
কোম্পানির কর্মচারীরা ভারতে নিজেদেরকে প্রভুর আসনে সমাসীন করেছিল৷ সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনে ইংরেজ কর্মচারীরা নিম্নপদস্থ ভারতীয়দের উপর নানাভাবে অত্যাচার নিপীড়ন চালাতে। যা দেশীয় কর্মচারীদেরকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
আরও পড়ুন-
সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যকার উত্তরাধিকার যুদ্ধ
B. সামাজিক কারণসমূহ
ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন:
ভারত শাসন করে ভারতীয় সম্পদ ইউরোপে পাচার করে নিজেদের সমৃদ্ধি আনলেও ব্রিটিশরা সামাজিকভাবে ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করত ৷ তারা এদেশের মানুষকে সর্বদায় সন্দেহের চোখে দেখত এবং তাদের স্পর্শ এড়িয়ে চলত। ভারতীয়দেরকে তারা পশ্চাৎপদ নিম্ন জাতি এবং নিজেদেরকে শাসন করার মতো অযোগ্য বলে মনে করত। অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ করতে তারা এদেশের মানুষকে "নেটিভ" বলে সম্বোধন করতে।
পাশ্চাত্য প্রভাব বিস্তার:
লর্ড মেকলে ভারতবাসীকে ব্রিটিশ আদলে গড়ে তোলার জন্য ইংরেজি শিক্ষা এবং ইংরেজিকে অফিশিয়াল ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন৷ বিচারালয় থেকে ফার্সি ভাষা এবং ফার্সি জানা লোকদেরকেও বাদ দেওয়া হয়৷ তাদের নানা বিধ সংস্কার এবং ক্রমবর্ধমান পাশ্চাত্যকরণ এদেশের হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ের অনুভূতিতে আঘাত হানে।
উন্নয়নমূলক কাজের সন্দেহ পোষণ:
কোম্পানির সরকারের সাথে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না৷ নিজের শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য তারা বেশকিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে৷ যেমন টেলিফোন লাইন স্থাপন এবং রেললাইন নির্মাণ। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তাদের এসমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতিও দেশের মানুষের সন্দেহ-সংশয় বৃদ্ধি পায়। যা ইংরেজ বিরোধী মনোভাব শক্তিশালী করে৷
নারী শিক্ষার প্রবর্তন:
তখনো ভারতে নারী শিক্ষার তেমন কোনো অগ্রগতি ছিলনা৷ ব্রিটিশরা ভারতে নারী শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তুলনামূলকভাবে এটি একটি ভালো পদক্ষেপ হলেও গোড়া ধর্মালম্বীদের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য ছিল না।
C.ধর্মীয় কারণসমূহ
ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা:
পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এদেশে মিশনারীদের কার্যক্রম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়৷ ইংরেজ শাসকদের সক্রিয় মদদে খ্রিস্টান মিশনারীরা হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার জোর তৎপরতা চালাতে থাকে৷ পাদ্রীরা হাটে-ঘাটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হাসপাতালে খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং হিন্দু ও ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে থাকে৷ এতিমখানার দুস্থদের অর্থের লোভ দেখিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করত।1850 সালে কোম্পানির সরকার ধর্মান্তরিতদের কে পৈত্রিক সম্পত্তি লাভ করার অধিকার দেয়। এরকম ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া ভারতবাসীদের ক্ষুব্ধ করে।
লাখেরাজ বাতিলকরণ
মুসলিম বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ এবং ইসলামিক প্রতিষ্ঠানের নামে মুঘল আমল থেকেই বেশকিছু লাখেরাজ ভূমি ছিল৷ এসব লাখেরা আজ ভূমির আয়ের মাধ্যমে ঐ সমস্ত ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হতো৷ কোম্পানি সরকার সব লাখেরাজ বাতিল করে দিলে মুসলিমরা একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিল৷ যা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করেছে।
সতীদাহ প্রথা বিলোপ:
হিন্দু ধর্মে সতীদাহ প্রথা একটি প্রচলিত রীতি ছিল। এই নীতির কারণে বিধবা নারীদের কে স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে হতো। রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় 1829 সালে উইলিয়াম বেন্টিং সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং বিধবা বিবাহ রীতি চালু করেন। তখনো হিন্দু সমাজের অধিকাংশ লোকই ছিল গোড়া, যারা এটিকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করত। হিন্দু সমাজের একটি বিরাট অংশ ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পোষণ করে।
বলিদান নিষিদ্ধকরণ:
হিন্দু ধর্মে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পূজা-অর্চনায় শিশু উৎসর্গ করা তথা বলিদান ছিল একটি প্রচলিত রীতি। যা কোম্পানি সরকার মানবিকতার দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ করেছিল। এটি ব্রিটিশদের প্রতি গোরা হিন্দুদের অসন্তুষ্টির একটি কারণ।
আরও পড়ুন-
হুমায়ুন-শেরশাহ (মুঘল-আফগান) সংঘর্ষ এবং শুরী বংশ প্রতিষ্ঠা
D. অর্থনৈতিক কারণসমূহ
নিপীড়নমূলক রাজস্ব নীতি:
1765 সালে দেওয়ানি লাভের পর থেকে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার যুগ, পাঁচশালা বন্দোবস্ত, 10 সনা বন্দোবস্ত এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইত্যাদি নীতির আলোকে গৃহীত সকল রাজস্ব নীতির মাধ্যমে এদেশের মানুষকে মারাত্মকভাবে শোষণ করা হয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে শুধু জমিদারই ছিল সরকারের প্রজা৷ আর সাধারন মানুষ ছিল জমিদারের প্রজা। মুষ্টিমেয় কিছু জমিদার ছাড়া ব্রিটিশ মদদপুষ্ট সকল জমিদার ই কৃষকদের ভিটায় ঘুঘু চড়িয়েছে। কোম্পানির অত্যাচারমূলক রাজস্ব নীতির কারণে এদেশের কৃষক সমাজ ফতুর হয়ে গিয়েছিল। এসব কারণে সাধারণ মানুষের মনে চরম ক্ষোভ পুঞ্জিভূত ছিল।
বহির্বাণিজ্যে একচেটিয়া ইংরেজ কর্তিত্ব:
কোম্পানি একটি বেনিয়া গোষ্ঠী। তারা মূলত ব্যাবসায়িক সুবিধা লাভ করতে গিয়েই এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল। আভ্যন্তরীণ এবং বহির্বাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। যা দেশীয় বণিকদের ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ধন সম্পদ পাচার:
মুঘলরা ভারতের বাইরে থেকে আসলেও তারা নিজেরা ভারতীয় হয়ে গেছে। তারা কখনোই ভারতীয় সম্পদ ভারতের বাইরে পাচার করেনি। কিন্তু বৃটিশদের দীর্ঘ শাসনামলে তারা ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করে নিজেদের দেশের সমৃদ্ধি ঘটায়। ব্রিটিশ শাসন-শোষণে ভারতবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
দেশীয় শিল্পের ধ্বংস সাধন:
তৎকালীন সময়ে ভারতীয় তাঁতশিল্প বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ ছিল৷ কোম্পানি তাদের বুনা মসলিন কাপড় জোরপূর্বক তাদের খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করতো। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে অনেক তাতী মসলিন বুনন বন্ধ করে দিলে তাদের আঙ্গুল কাটা হত। এসময় ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব হলে ভারতীয় সব ধরনের শিল্প পণ্য উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এবার কোন তাতী মসলিন বুনলে তার আঙ্গুল কাটা হত। বাধ্যতামূলকভাবে কৃষকদেরকে নীল চাষ করতে হতো। এভাবে দেশীয় শিল্পকে তারা ধ্বংস করেছিল।
বেকারত্ব বৃদ্ধি:
ইতিপূর্বে কিছু ভারতীয় ইংরেজি শিখে চাকরির যোগ্যতা অর্জন করলেও কোম্পানি অল্পসংখ্যক ভারতীয়দেরকে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
জমিদারি বণ্টনের বৈষম্য:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে দেশের ভূমি ও রাজস্ব প্রশাসনের আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। প্রকৃত জমিদারদের বাদ দিয়ে কোম্পানি উদীয়মান পুঁজিপতি ফটকাবাজদেরকে জমিদারি বন্দোবস্ত দেয়। নানাবিধ ভাবে যোগ্য জমিদারদেরকে বঞ্চিত করা হয় এবং যারা টিকেছিল আইনের ফাঁদে ফেলে তাদের জমিদারী খন্ড-বিখন্ড করে উচ্ছেদ করা হয়।
E. সামরিক কারণসমূহ
বেতন বৈষম্য:
ইউরোপীয় এবং দেশীয় সেনা সদস্যদের বেতনের ক্ষেত্রে ছিল আকাশ পাতাল পার্থক্য। যেখানে একজন দেশীয় সৈন্যের বেতন ছিল মাসিক ৯ টাকা বিপরীতে একজন ইউরোপীয় সৈনিকের মাসিক বেতন ছিল ১৫০ টাকা। ২,৫৭,৪০০ ভারতীয় সৈন্যের ব্যয় ছিল ৯৮ লক্ষ পাউন্ড আর মাত্র ৩৪ হাজার ইউরোপিয়ান সৈন্যের পেছনে ব্যয় করা হতো ৫৭ লক্ষ পাউন্ড। ভারতীয় সিপাহীদের বেতন বৈষম্য এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ।
দেশীয় সিপাহীদের প্রতি অবজ্ঞা ও অত্যাচার:
উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা দেশীয় সামরিক কর্মচারীদের প্রতি অবজ্ঞা ও অশালীন আচরণ করতো। ব্রিটিশ সামরিক কর্মচারীদের নিপীড়ন, ব্যভিচার, মদ্যপান, অবৈধ নারীসঙ্গ ইত্যাদি নানাবিধ অনৈতিক কর্মকান্ড রক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলিম সমাজে ছিল খুবই আপত্তিজনক। এসব ঘটনা ভারতীয় সিপাহী ও সাধারণ জনতার মনে একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।
সামরিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি:
নৈতিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি বৃটিশ সামরিক কর্মকর্তারা এ দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বৈভবের মালিক হয়ে তা ইংল্যান্ডে পাছার করেছিল।
সমুদ্র পাড়ি দিতে বাধ্য করা:
হিন্দু রীতিতে সমুদ্র পাড়ি দেয়া পাপ বলে তারা মনে করত। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া ভারতীয় সেনাদেরকে প্রশিক্ষণসহ নানাবিধ কারণে ইংল্যান্ডে পাঠানো হলে তারা সেটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।
উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ:
ভারতে ইউরোপিয়ান সৈন্যদের পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হতো। তারা সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করা সত্ত্বেও অধস্তন ভারতীয় সিপাহী ও অন্যান্যদের প্রতি উদ্ধত্যপূর্ণ ও অশালীন আচরণ করত। তাদের বাড়াবাড়ি ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেশীয় সিপাহীদেরকে বিষিয়ে তোলে।
আরও পড়ুন-
শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ও প্রশাসনিক সংস্কার
খ. প্রত্যক্ষ কারণ
সর্বশেষ 1856 সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল এর প্রচলন করা হয় যার কার্তুজ ব্যবহারের আগে দাঁত দিয়ে কাটতে হত। একসময় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে এই কার্তুজে গরু ও শূকরের চর্বি ব্যবহার করা হয়েছে। মুসলমানদের কাছে শূকরের চর্বি আর হিন্দুদের কাছে গরুর চর্বি ছিল ধর্মীয় নিষিদ্ধ বস্তু। এ অবস্থায় হিন্দু-মুসলিম উভয়ের মধ্যে মারাত্মক অসন্তোষ ও উত্তেজনা দেখা দেয়। অভিযোগ করা হয় যে মুসলিম ও হিন্দু সিপাহীদের ধর্মীয় চেতনা ধ্বংস করার জন্যই এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। অতঃপর 1857 সালর 29 মার্চ 34 নং ব্যাটালিয়ান ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এরপর মিরাটে, ঢাকা, চট্টগ্রাম এ বিদ্রোহ ছড়িযে পড়ে। বিদ্রোহে সিপাহীদের স্লোগান ছিল ‘খালক ই খোদা, মুলুকে বাদশা, হুকুমের সিপাহী’।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফল:
কোম্পানির সরকার এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে। ইতিপূর্বে স্থাপিত টেলিফোন লাইন ও রেল সুবিধা প্রয়োগ করে কোম্পানি এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। বিদ্রোহের সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রতি কঠোর অত্যাচার করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। বহু সিপাহি কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। বিশেষ করে মুসলমানদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
বিদ্রোহীদের শাস্তি প্রদান:
সিপাহী বিদ্রোহ ব্যাপক আকারে দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। কোম্পানির টেলিফোন টেলিগ্রাম ওরেল সুবিধা কাজে লাগিয়ে কঠোরভাবে এ বিদ্রোহ দমন করে। বিদ্রোহে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বহু সংখ্যক ভারতীয় কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। সংশ্লিষ্টদের অত্যাচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। সামান্য পরিমাণ অভিযোগ থাকলেও তাদেরকে প্রকাশ্যে ফাসি দিয়ে হত্যা করা হয়। সদরঘাটের বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কে (পূর্বনাম ভিক্টোরিয়া পার্ক) বিপুল পরিমাণ বিদ্রোহীকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ:
কোম্পানির সরকার বিদ্রোহীদের শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।
মুসলমানদের উপর অত্যাচার বৃদ্ধি:
সিপাহী বিদ্রোহের জন্য মুসলমানদেরই কোম্পানি বেশি দায়ী করে। এরপর মুসলমানদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ও বিভিন্ন অভিযোগে বহু মুসলমানকে হত্যা করা হয়। তখনো ব্রিটিশরা মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে।
মুঘল সম্রাটের নির্বাসন:
সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর কে কোম্পানি গ্রেফতার করে এবং তাকে রেঙ্গুনে নির্বাচনে পাঠায়।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতন:
মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর কে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠালে ভারতে 332 বছরের মুঘল সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।
মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট:
ভারতীয় মুসলিমরা তখনও মুঘল সম্রাটকে তাদের ঐক্যের প্রতীক বলে বিবেচনা করতো। মুঘল সম্রাটকে নির্বাসনে পাঠালে এবং মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ভারতে মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট হয়।
স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল:
লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতি বিদ্রোহের একটি অন্যতম কারণ ছিল। বিদ্রোহের পর সরকার স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল করে এবং সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি পরিত্যাগ করে।
কোম্পানি শাসনের অবসান:
1857 সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর পরই ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে। ১৮৫৮ সালে বৃটেনের রানীর এক আদেশে এখানে সরাসরি রানীর শাসন জারি করা হয়। গভর্নর জেনারেল এর পরিবর্তে ভাইসরয় এর শাসন চালু হয়।
ব্রিটিশ সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি :
বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভবিষ্যতের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ভারতে ইউরোপীয় সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে।
ডিভাইড এন্ড রুল নীতি চালু:
হিন্দু-মুসলিম উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ফলে ব্রিটিশ সরকার হিন্দু এবং মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে এবং তারা তাদের সাম্রাজ্যর ভিত মজবুত করার জন্য হিন্দু এবং মুসলিম দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি বাস্তবায়ন শুরু করে।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ:
সিপাহী বিদ্রোহের পরিসমাপ্তির পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনব্যবস্থা এককেন্দ্রিকরণ নীতি পরিহার করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করে কাউন্সিল অ্যাক্ট পাস করে মুম্বাই ও মাদ্রাজ কাউন্সিলের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হয়।
ভারতীয়দের অধিক সংখ্যক নিয়োগদান:
ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। অতঃপর ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অধিক সংখ্যক ভারতীয়দের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে।
মুসলিম নবজাগরণ:
এই বিদ্রোহের পর মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের সন্দেহ বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আব্দুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী এই সংশয় সন্দেহ দূর করার জন্য মুসলমানদেরকে ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে থাকেন। ফলে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের নবজাগরণের সূচনা হয় যা পরবর্তীতে মুসলিম জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে সহায়তা করে।
ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথিকৃৎ:
বিদ্রোহ তাৎক্ষণিক সফলতা না পেলেও এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের মূলভিত্তি। এই বিদ্রোহের পর ভারতীয়দের মনে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। এর প্রেক্ষিতে তারা রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল এবং তারই প্রেক্ষিতে 1947 সালের ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল।
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত
আরও পড়ুন-
ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবঃ কারণ, বিকাশ, গতি-প্রকৃতি ও ফলাফল
[প্রিয় পাঠক,
যে কোন ভূল-ত্রুটির সংশোধনী বা পরামর্শ থাকলে ওয়েব সাইটে পোস্টের নিচে কমেন্ট বক্সে লিখুন। ইসলামের ইতিহাস, স্বাধীন-বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ইসলামের বিধি-বিধান সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধ বা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে লেখা কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে চাইলে আপনার লেখা এবং পরিচিতিসহ মেইল করুন। ]
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History
এত সুন্দর করে গুছিয়ে লিখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
ReplyDeleteঅসাধারণ লিখেছেন
ReplyDelete