হযরত উসমান (রা.) এর হত্যাঃ
কারণ ঘটনা ও ফলাফল
হযরত উসমান (রা.) এর উপর আনীত অভিযোগ সমূহের উপর ভিত্তি করে বিদ্রোহীরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। খলীফা তখন তাদের প্রতি উদার মনোভাব প্রকাশ করেন। কারণ তিনি মুসলিমদের মাঝে এই বিভক্তি চাননি। কিন্তু তার এই শিথিলতার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে তার হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে।
হযরত উসমান (রা.) এর হত্যার কারণসমূহ
উমাইয়া ও হাশেমী দ্বন্দ্ব
প্রাক-ইসলামী যুগের আরবের উমাইয়া ও হাশেমী দ্বন্দ্ব, যা মক্কার রক্ষণাবেক্ষণকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত হয়েছিলো তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উমাইয়ারা ইসলাম গ্রহণ করে মক্কা বিজয়ের সময়। হযরত উমর (রা.) পর্যন্ত এই দুই গোষ্ঠী লোকের মধ্যে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু উমাইয়া বংশের লোক হযরত উসমান (রা.) যখন খিলাফত গ্রহণ করেন, তখন হাশিমী গোত্র তা সহ্য করতে পারলো না। বিশেষ কওে হযরত আলী (রা.) এর পন্থীরা। তাই সেই প্রাচীন আরবীয় গোত্রের কলহ তাদের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জীবন ও কর্ম: নবুয়ত লাভের পূর্ব পর্যন্ত
কুরাইশ ও অকুরাইশ দ্বন্দ্ব
ইসলাম সম্প্রসারণে সকল মুসলিম কুরাইশদের সাথে সম্মিলিত ভাবে প্রাণপণ যুদ্ধ করে। কিন্তু তাদের সুযোগ সুবিধার প্রতি খলীফার দৃষ্টি সমানভাবে ছিল না। ক্ষমতা শুধু কুরাইশকেন্দ্রিক থাকবে এই ধারণাও অকুরাইশদের মনঃপুত হয়নি। উসমান (রা.) হযরত উমরের আরবীয় আভিজাত্য নীতি হতে সরে আসলেন, বিজিত অঞ্চলে কুরাইশরা তাদের বসতি স্থাপন শুরু করে। এতে করে কুরাইশ ও অকুরাইশদের মধ্যে নানান বিষয়ে দ্বন্দ¦ দেখা দেয়।
ইবনে সাবার অপপ্রচার
এমন অনেক লোক ছিলো যারা ইসলামকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য ইসলাম গ্রহণ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা ছিলেন সেই প্রকৃতির লোক। তিনি ছিলেন ইয়েমেনের এক নিগ্রো মাতার গর্ভজাত ইহুদি সন্তান। বসরার শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ ইবনে আমিরের হাতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। সে প্রচার করতে থাকেন যে, হযরত আলী (রা.) মহানবী (সা.) এর একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী। সুতরাং খিলাফতের অধিকার একমাত্র তারই। সে বসরা ও কুফায় এই মতবাদ প্রচার করতে থাকেন। এ সকল প্রদেশের শাসকগণ তাকে নিজ নিজ শহর হতে বিতাড়িত করেন। তারপর সে মিসরে গমন করে এবং কতিপয় ব্যক্তির সমর্থন লাভ করে। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন হাকিম বিন-জাবালা ও মুহাম্মদ বিন-আবু বকর। তার এই অপপ্রচারের ফলে বসরা, কুফা ও মিসরে খলীফা বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে।
আনসার-মুহাজির দ্বন্দ¦
মহানবী (সা.) মদীনায় আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। কিন্তু খলীফা উসমান (রা.) এর শাসনামলে আনসারদের তুলনায় মুহাজিরদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদ হতে বঞ্চিত করা হয়। এতে তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
অমুসলিমদের অসন্তোষ
বিভিন্ন বিধর্মী সম্প্রদায় যেমন ইহুদি, খ্রিস্টান, মাজিয়ান তারা সব সময়ই ছিল ইসলাম-বিরোধী। তারা রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিরোধীতা শুরু করে। কুরাইশদের উচ্চপদ লাভ তাদের মধ্যে ঈর্ষাকাতরতা সৃষ্টি করে। তারাও বিদ্রোহীদের সমর্থন করতে থাকে।
কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ
বিদ্রোহীরা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় শাসনে অনভ্যস্ত যাযাবর আরব জাতি এই শাসন মেনে নিতে পারেনি। হযরত উসমান (রা.) এর শাসনের শেষ ছয় বছর সীমান্ত যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গণিমাতের উৎস বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদের অয়ের অন্যতম উৎস ছিল আল ফাই ভূমি যা হযরত উমর (রা.) এর সময়ে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। এই কারণে আরব যোদ্ধারা অসন্তুষ্ট হয়ে যায় এবং তারা আল ফাই ভূমির আয় দাবি করে। এই দাবি ছিল সম্পূর্ণরুপে বিদ্রোহী মনোভাব ও অযৌক্তিক। খলীফা উসমান (রা.) বহুলাংশে হযরত উমর (রা.) এর রাজস্ব নীতি পরিবর্তন করলেও তিনি এই দাবি মেনে নিতে পারেন নি। তাই সর্বত্র তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দেয়।
আরও পড়ুন-
রিদ্দার যুদ্ধঃ কারণ ঘটনা ও ফলাফল
মারওয়ানের ধ্বংসাত্মক নীতি
মারওয়ান ছিল খলীফা উসমান (রা.) এর চাচাতো ভাই। তার অতীত ছিল কদর্যপূর্ণ। একবার বিশ্বাস ভঙ্গের দায়ে রাসূল (সা.) তাকে মদীনা হতে বহিষ্কার করেন। সে খলীফার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা হস্তক্ষেপ করেন। এই স্বার্থপর ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে উমাইয়াদের নিয়োগ করেন। হাশিমীদের সকল প্রকার ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখাই ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য। মারওয়ানের এই ধ্বংসাত্মক নীতি খলীফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উস্কানি হিসেবে কাজ করে।
হযরত উসমান (রা.) এর হত্যার ঘটনা
পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন অভিযোগ ও কারণ সমূহের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশ হতে (কুফা, বসরা ও মিসর) প্রায় ৭০০ বিদ্রোহী মদীনায় এসে উপস্থিত হন। তারা প্রাদেশিক গভর্ণরদের বিরুদ্ধে খলীফার নিকট অভিযোগ পেশ করেন। খলীফা তাদের নিকট দ্রুত এই প্রতিকারের ওয়াদা প্রদান করেন। পথিমধ্যে নিজ নিজ প্রদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় কুচক্রী মারওয়ান কর্তৃক প্রেরিত এক হাবশি দূতের হাতে খলীফা সীলমোহরসহ একটি পত্র বিদ্রোহীরা হস্তগত করেন। উক্ত পত্রে লিখা ছিল নিজ-নিজ প্রদেশের রাজধানীতে পৌঁছামাত্রই যেন বিদ্রোহীদের হত্যা করা হয়। মূলত এই পত্রটি ছিল মারওয়ানের হস্তে লেখা এবং এতে খলীফার সীল অন্যায়ভাবে মারওয়ান নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেন। এতে বিদ্রোহীরা ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং মদীনায় ফিরে গিয়ে উক্ত পত্রের কৈফিয়ৎ দাবি করে। খলীফার আল্লাহর শপথ নিয়ে দাবি করেন যে, তিনি কোনভাবেই এই পত্র তৈরির আদেশ করেননি। এত বিদ্রোহীরা মারওয়ানের কূটচাল সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং মারওয়ানকে তাদের হাতে হস্তান্তরের জন্য দাবি জানায় কিন্তু খলীফা তাদের এই দাবী গ্রহণ করতে পারেনি। তখন বিদ্রোহীরা খলিফাকে অযোগ্য ঘোষণা করে এবং তার বাসগৃহ অবরোধ করে। খলীফার নিরাপত্তার প্রতি উদ্বিগ্ন হয়ে হযরত আলী, তালহা, যুবায়ের ও তাদের পুত্রদ্বয়ের সমন্বয়ে ১৮ জনের একটি দেহরক্ষী বাহিনী খলীফার বাসগৃহে পাহাড়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই সময় হজ্জের মৌসুমের শেষ হতে শুরু করে। তাই মদীনার লোকজন ফিরে আসার আগেই বিদ্রোহীরা খলিফাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তারা সম্মুখ দরজার পাহারাদারদের দ্বারা বাধাগ্রস্থ হলে দেয়াল টপকে ছাদের মাধ্যমে খলীফার গৃহে প্রবেশ করে। ৮২ বছরের বৃদ্ধ খলীফা এই সময় পবিত্র কুরআন পাঠে নিয়োজিত ছিলেন। মুহাম্মদ বিন আবু-বকর খলীফার দাড়ি ধরে টান দেন। খলীফা এই সময় তাকে তাঁর পিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে মুহাম্মদ বিন আবু বকর সেখান হতে দূরে সরে গেলেন। অত:পর অপর বিদ্রোহীরা খলীফাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। খলীফা স্ত্রী নায়লা তাদের বাধা দিতে এগিয়ে এলে তাঁর হাতের তিনটি আঙ্গুল কেটে যায়। এই হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে ৬৫৬ খি ঃ ১৭ ই জুন (১৮ ই জিলহজ্ব, ৩৫ হিজরী)।
হযরত উসমান (রা.) এর হত্যার ফলাফল
বিদ্রোহের/গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত:
হযরত উসমান (রা.) এর হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে ইসলামে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। উষ্ট্রের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধ এবং কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকা- ছিল এই হত্যাকা-ের সুদূরপ্রসারী ফলাফল। উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠা ও পতনের পরও এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেনি।
উমাইয়া ও হাশিমী গোষ্ঠীর উদ্ভব:
মুসলিমদের ঐক্যে ভাঙ্গনের ফলে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারা উমাইয়া ও হাশিমী দলে বিভক্ত হয়ে যায়। উমাইয়া ও হাশিমী দ্বন্দ্ব আরো চরম আকার ধারণ করে।
খিলাফতের মর্যাদাহানি:
এই হত্যাকা-ের ফলে খিলাফতের পবিত্রতা নষ্ট হয়। খিলাফত ছিল জনগণের শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি। মহানবী (সা.) এর মহান আদর্শকে টিকিয়ে রাখা ও অনুসরণ করাই ছিল খিলাফতের উদ্দেশ্য। কিন্তু এই হত্যাকা-ের মধ্যদিয়ে অপঘাতে একজন ধর্মভীরু খলীফার মৃত্যু ঘটে এবং এই ঘটনা খিলাফতের ধর্মীয় মর্যাদাকে ব্যাপকভাবে আঘাত করে।
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উদ্ভব:
এই হত্যাকা-ের ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দলে, উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তিরোহিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গোড়া পন্থীদের উদ্ভব হয়। মুসলিম জাতি তখন শিয়া, সুন্নি, খারেজী প্রভৃতি দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
মদীনার প্রাধান্য লোপ:
হযরত উসমান (রা.) হত্যাকা-ের পর মদীনার প্রাধান্য লোপ পায়। মদীনা খিলাফতের রাজধানীর মর্যাদা হারায়। পরবর্তী খলীফা হযরত আলী (রা.) কুফায় তার রাজধানী স্থানান্তর করেন। পরবর্তীতে রাজতান্ত্রিক খিলাফতের সময় দামেস্ক, বাগদাদ, কর্ডোভায় রাজধানী স্থাপন করা হয়।
আরও পড়ুন-
বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন
আরও পড়ুন-
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল
আরও পড়ুন-
হযরত উসমান (রা.) এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ পর্যালোচনা
সংগৃহীত ও পরিমার্জিত
External Link
http://www.ebookbou.edu.bd/Books/Text/OS/HSC/hsc_1856/Unit-06.pdf
No comments:
Post a Comment