পলাশীর যুদ্ধ:
কারণ, ঘটনা, ফলাফল এবং এতে নবাবের পরাজয়ের কারণ
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে সংঘটিত হয় পলাশীর যুদ্ধ। এ যুদ্ধ প্রায় আট ঘণ্টার মতো স্থায়ী ছিল এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার কারলে নওয়াব কোম্পানি কর্তৃক পরাজিত হন। এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী ও ধ্বংসাত্মক । এর ফলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলাকে কেন্দ্র করেই ক্রমান্বয়ে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তার করে এব তারা ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ গ্রাস করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এশিয়ার অন্যান্য অনেক অংশও ভারতীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
পলাশীর যুদ্ধের কারণসমূহ
সামরিক দুর্গ নির্মাণ:
আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার সুযোগে কোম্পানি কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করলেও পরবর্তীতে তারা আর কখনো সেটা বন্ধ করেনি বা ধ্বংস করেনি। ব্রিটিশরা কলকাতায় আর ফরাসিরা চন্দননগরে সামরিক দুর্গ সম্প্রসারণ করতে থাকে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশকে ফরাসিরা দুর্গ নির্মাণ বন্ধ করলেও ব্রিটিশরা তা বন্ধ করেনি। নবাবের আদেশ অমান্য করে সামরিক দুর্গের সম্প্রসারণ পলাশীর যুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ।
বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব
ইংরেজরা ১৭১৭ সালে মোঘল সম্ভ্রাট ফারুকসিয়ারের কাছ থেকে দস্তক লাভ করে। এর ফলে তারা বাংলায় কয়েকটি পন্যের বিনাশুল্কে বানিজ্য করার অধিকার পায়। কিন্তু কোম্পানি ও কোম্পানির কর্মচারীরা এর অপব্যবহার শুরু করলে নবাবের ব্যাপক রাজস্বের ক্ষতি হয়। সিরাজউদ্দৌলা এর প্রতিবাদ করলে ইংরেজদের সাথে বিরোধ হয়।
সার্বভৌম জমিদারী:
নবাব সিরাজউদ্দৌলা ঘোষণা দেন যে তিনটি কারণে তিনি কোম্পানিকে তাড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-
এরা দেশের প্রচলিত আইন কানুন অমান্য করে কলকাতায় দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ ও পরিখা স্থাপন করেছে
এরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে দস্তকের অপব্যবহার করছে
জমিদারির ইজারা নিয়ম ভঙ্গ করে এরা কলকাতার জমিদারিকে নিজেদের সার্বভৌম এলাকা হিসেবে গণ্য করেছে। [প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম, বাংলার ইতিহাস ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো, পৃ. ১৭]
কোম্পানির উদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব:
নতুন নবাবের প্রতি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আচরণ অবাধ্যতা এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল। নবাবের যেকোনো নির্দেশনার প্রতি কোম্পানি ছিল একেবারেই উদাসীন। কোম্পানির ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব নবাব স্বভাবতই উস্কানিমূলক বলে গ্রহণ করেন।
মুর্শিদকুলি এবং আলীবর্দী খানের দুর্বলতা:
মুর্শিদকুলি খান এবং আলীবর্দী খানের সাথে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে কোম্পানির দ্বন্দ্ব ছিল কোম্পানির কাছ থেকে বাণিজ্য শুল্ক আদায় করলেও তারা উভয়ে কোম্পানির সামরিক স্থাপনা তথা দুর্গ নির্মাণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
দুর্গ নির্মাণ বন্ধ না করা:
দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসিরা বাংলায় দুর্গনির্মাণ শুরু করে সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশে ফরাসিরা দুর্গনির্মাণ বন্ধ করলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ বারংবার অমান্য করে। এই ঘটনায় নবাব অত্যন্ত রেগে যান ও দুর্গনির্মাণে সামরিক হস্তক্ষেপ করেন।
নবাবের প্রতি শুভেচ্ছা ও উপঢৌকন প্রেরণ না করা:
সিরাজউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসলে প্রথা অনুযায়ী নবাবের প্রতি তার আনুগত্য জানিয়ে ফরাসি ও ওলন্দাজ প্রভৃতি কোম্পানিগুলি উপঢৌকন পাঠালেও ইংরেজরা ইচ্ছা করে তা করেনি। এতে সিরাজউদ্দৌলা অপমানিত হন।
নবাবের দুতের অপমান:
দুর্গনির্মাণ, দস্তকের অপব্যবহার, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সিরাজ নারায়ন দাসকে দুত হিসাবে কলকাতায় পাঠান। ইংরেজরা নারায়ন দাসকে গুপ্তচর বলে অপমান করে এবং তাড়িয়ে দেয়।
প্রাসাদ ষড়যন্ত্র:
নবাব সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণের শুরু থেকেই ঘষেটি বেগম, শওকত জঙ্গ ও কয়েকজন, রাজকর্মচারী তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার কানে খবর আসে যে ইংরেজ কোম্পানি এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং তাকে সরিয়ে অন্য কাউকে নবাব পদে বসানোর জন্য চক্রান্ত চলছে। কলঙ্কজনক এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতক জগৎ শেঠ,মাহতাব চাঁদ, মীরজাফর,মহারাজা স্বরূপচাঁদ, উমিচাঁদ বা আমির চন্দ,, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগমের ক্ষমতার লোভ এই ষড়যন্ত্রের পিছনে কাজ করেছিল। রাজা রাজবল্লভ, মহারাজ নন্দকুমার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রানী ভবানী প্রমুখের কৌশলী চক্রও এর পেছনে প্রচ্ছন্ন ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের শিকার ছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার বিশ্বস্তরা।
হিন্দু-ইংরেজ ষড়যন্ত্র:
‘পলাশী কার চক্রান্ত?’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে শ্রী সুনীল চৌধুরী লিখেছেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতার দায় শুধু মীর জাফরের নয়। জগৎশেঠদের দায় মীর জাফরের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়।’ আসলে ইতিহাস পরিক্রমায় একটু পিছিয়ে গেলেই দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সবক’টা রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য অংশ নিয়েছে।এ সময়কার রাজনীতিতে পটপরিবর্তনের চাবিকাঠি ছিল জগৎশেঠদের হাতে। ক্লাইভের লেখা চিঠিপত্র দেখার পর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, পলাশী চক্রান্তের পেছনে ইংরেজরা সবচেয়ে বেশি মদদ পেয়েছিল জগৎশেঠদের কাছ থেকে।
ঐতিহাসিক তপন মোহন চট্টোপাধ্যায় ‘পলাশীর যুদ্ধ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদের ষড়যন্ত্র’...। চক্রান্তটা হিন্দুদের হলেও তা কার্যকর করার জন্য বড় মাপের একজন মুসলমানের প্রয়োজন ছিল। যিনি সিরাজউদ্দৌলার জায়গায় বাংলার নবাব হবেন। ক্লাইভ তো নিজে হতে পারেন না। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু নবাবও কেউ গ্রহণ করবে না ? কিন্তু ক্লাইভ এমন ব্যাক্তিকে নবাব পদে বসাতে চান যিনি ইরেজদের তাবেদার থেকে তাদেরই কথা কথা মত নবাবী পরিচালনা করবেন। ক্লাইভ মনে মনে মীর জাফরকেই বাংলার ভাবী নবাব পদের জন্য মনোনীত করে রেখেছিলেন।
কৃষ্ণদাস কে আশ্রয়দান:
ঘষেটি বেগমের প্রিয়পাত্র ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ আর্থিক তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা রাজস্বের সঠিক হিসাব নিয়ে মুর্শিদাবাদে হাজির হতে বলে। রাজবল্লভ নবাবের নির্দেশে অমান্য করে প্রচুর ধনরত্নসহ পুত্র কৃষ্ণদাসকে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন কিন্তু ইংরেজরা এই নির্দেশ অমান্য করে। এই ঘটনায় সিরাজ প্রচণ্ড রেগে যান।
নবাব কর্তৃক কাশিমবাজার দখল:
এভেোব একের পর এক ঘটনায় নবাব উপলব্ধি করেন, ইংরেজরা তার সার্বভৌম ক্ষমতাকেই চ্যালেঞ্জ করছে। তাই তাদের শিক্ষা দিতেই নবাব প্রথমে অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে কাশিমবাজার কুঠি এবং পরে কলকাতা দখল করেন। গভর্নর ড্রেক এর নেতৃত্বে এসময় কোম্পানির লোকেরা জাহাজে করে ফলতায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু হলওয়েলের নেতৃত্বে ১৪৬ জন ইংরেজ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে থেকে যায়। নবাব কলকাতা দখলের পর এর নাম রাখেন আলীনগর। নবাব সেনাপতি মানিক চাঁদকে কলকাতার শাসক নিযুক্ত করে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।
তথাকথিত অন্ধকূপ হত্যার কল্পকাহিনী:
নবাব সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কাশিমবাজার দখলের পর ইংরেজরা অভিযোগ করেছিল যে এই সময় নবাব 123 জন ইংরেজকে একটি ছোট্ট ঘরে বন্দী করে রেখেছিলেন যেখানে তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। যা অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিতি পায়।
কোম্পানির কর্মচারী জন যেফানিয়াহ হলওয়েল তার রচিত ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস্ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে কাশিমবাজার দুর্গ অবরোধের সময় ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের একটি জালনা বিহীন কক্ষে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দী করে রেখেছিলেন সেখানে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জন মারা গিয়েছিল।
অক্ষয় কুমার মিত্র তার সিরাজউদ্দৌলা (১৮৯৮) নামক গবেষণামূলক গ্রন্থে এই কাহিনীর অসততা প্রমাণ করেছেন। ১৯১৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় তিনি অন্ধকূপ হত্যাকে অলীক ও ইংরেজ কোম্পানির মিথ্যাচার বলে প্রমাণ করেন।
কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ২৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থের একটি কামড়ায় কোনভাবেই ১৪৬ জন মানুষকে প্রবেশ করানো যায় না। ফলে এই ঘটনার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠে এবং বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হেয় করতেই এই অসত্য আজগুবি কাহিনী সাজানো হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। অ্যানি বেসান্ত মন্তব্য করেন যে, “Geometry disproving arithmetic gave the lie to the story.”
গবেষক নোয়েল বারকারের (Noel Barker) মতে,“অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সত্যি, কিন্তু খুব বেশি লোকের মৃত্যু হয় নি এবং এই ঘটনার জন্য নবাব কোনো ভাবেই দায়ী ছিলেন না।
আলিনগরের সন্ধি:
কাশিমবাজার ও কলকাতায় ইংরেজদের পতনের খবর মাদ্রাজে পৌঁছালে কর্নেল ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে একটি নৌবহর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্ৰসর হয়। অতি সহজেই, (২ জানুয়ারি ১৭৫৭ খ্রি.) একরকম বিনা বাধায় কলকাতা ইংরেজদের দখলে চলে আসে। ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাস, কলকাতার শাসনকর্তা মানিকচাঁদকে উৎকোচ দিয়ে ইংরেজরা কলকাতা পূর্ণদখল করে। দরবারের অনেকের ষড়যন্ত্রের কারনে নবাবের এবারের কলকাতা অভিযান ব্যর্থ হয়। ফলে তিনি আলিনগরের সন্ধি (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭ খ্রি.) করতে বাধ্য হন।
আলিনগরের সন্ধির শর্ত অনুসারে ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ, বিনা শুল্কে বাণিজ্য ও নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা চালু করার অধিকার পায়। বলা বাহুল্য, এই সন্ধির ফলে ইংরেজদের প্রভাব – প্রতিপত্তি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এতদিন পর্যন্ত নবাবের অধিনস্থ একটি জমিদারি মাত্র ছিল কলকাতা। নবাবের পরাজয়ের ফলে কলকাতা হয়ে ওঠে প্রায় একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, আর এর কর্তৃত্বের অধিকারী হয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাছাড়া নবাবের পরাজয় ইংরেজদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় জোয়ার নিয়ে আসে।
নন্দকুমারের চক্রান্ত।
নন্দকুমার তখন হুগলির ফৌজদার ছিলেন। নবাব নন্দকুমার কে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, যদি ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করে তিনি যেন সৈন্য নিয়ে ফরাসিদের সাহায্য করেন। লর্ড ক্লাইভ নবাবের আদেশ উপেক্ষা করে চন্দননগর আক্রমণ করে এবং তা অধিকার করে নেয়। নন্দকুমার, রায় দুর্লভ ও মানিকচাঁদ নবাবের নির্দেশমতো ফরাসিদের সাহায্য করেননি। নন্দকুমার নিজের সাফাইয়ের জন্য নবাবকে জানান যে ফরাসিরা এত বেশি দুর্বল ছিল যে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসলে অযথা নবাবের শক্তি ক্ষয় হবে। মূলত এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। ফলে নবাব তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে পারেননি।
মীরজাফর-কোম্পানি গোপন চুক্তি:
ক্লাইভ জানতে পারেন যে, নবাবের বিরুদ্ধে দরবারে একটা ষড়যন্ত্র চলছে এবং জগৎ শেঠ এ ষড়যন্ত্রের মূলনেতা। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল এবং দরবারের অসন্তুষ্ট অমাত্যদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্য উমিচাঁদকে ব্যবহার করেন, যার ফলে ১৭৫৭ সালের ১৯ মে গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়। অভ্যুত্থানের নেতা নির্বাচিত করা হয় প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানকে এবং রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম, নন্দকুমার, ইয়ার লতিফ, মানিকচাঁদ, কৃষ্ণবল্লভ প্রমুখ এ ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। এতে মীর জাফরকে নবাবের আসনে বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। এর বিনিময়ে ইংরেজদেরকে প্রায় বিশ লাখ পাউন্ড প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয় মীর জাফর।
আরও পড়ুন-
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ: কারণ ও ফলাফল
পলাশীর যুদ্ধ ও ঘটনা প্রবাহ
(২৩ জুন,১৭৫৭)
গোপন চুক্তি সম্পাদনের পর ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সন্ধি ভঙ্গের মিথ্যা অজুহাত তুলে সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হন। নবাব পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে পলাশীর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন। 1757 সালের 23 জুন সকালবেলা যুদ্ধ শুরু হয়। মীর মদন এবং মোহনলালের অতর্কিত আক্রমণে ক্লাইভ বাহিনী পিছু হটে। কিন্তু এই যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের চক্রান্তে সেনাবাহিনীর একটি বিশাল অংশ যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকে। এরই মধ্যে হঠাৎ মীর মদন মৃত্যুবরণ করলে মোহনলাল যুদ্ধ চালাতে থাকেন। এ সময় মীরজাফর গোপন চুক্তি মোতাবেক ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য নবাব কে যুদ্ধ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। মীরজাফরের সর্বনাশা পরামর্শ গ্রহণ করে নবাব মোহনলালকে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার আদেশ দেন। ইতিমধ্যে খানিকটা বৃষ্টি হয়েছিল। নবাবের গোলা-বারুদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে বৃষ্টিতে সেগুলো অকেজ হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে ক্লাইভের গোলা-বারুদ ছিল সুরক্ষিত। এসময় মীরজাফরের পরামর্শে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা নবাবের বাহিনীর উপর ক্লাইভ অতর্কিত আক্রমণ করে। নবাবের অপ্রস্তুত বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে আত্মরক্ষার্থে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলায়ন করেন। পথিমধ্যে ধৃত হয়ে শৃঙ্খিত অবস্থায় তাকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়। অতঃপর মীরজাফরের আদেশে তাহার পুত্র মিরন কারাগারে আবদ্ধ অবস্থায় মোহাম্মদী বেগকে দিয়া নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে হত্যা করেন।
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল
পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ হতাহতের সংখ্যা এবং যুদ্ধের ব্যাপকতার বিচারে এটিকে একটি খন্ড যুদ্ধ বলা চলে। কিন্তু এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
কোম্পানি শাসনের ভিত্তি স্থাপন
পলাশীর যুদ্ধে জেলাবের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তীতে বাংলা থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উত্তর ভারতে তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে
মীরজাফরের নবাবী লাভ:
পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রথম ঘটে এবং মীরজাফর বাংলার নতুন নবাব হিসেবে আসীন হন।
বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিলুপ্তি
পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিলুপ্তি ঘটে। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন নবাব।
কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা
যুদ্ধে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা তথা ভারতে রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক একচেটি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিনা শুল্কে এর বাণিজ্য করার কারণে দেশীয় বণিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফরাসিদের বিতাড়ণ
ইংরেজরা এই যুদ্ধে জয় লাভের ফলে বাংলা থেকে ফরাসিরা বিতাড়িত হয়। বাংলার অর্থ কাজে লাগিয়ে কোম্পানি দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়।
বাংলার কৃষি ও তাঁত শিল্প ধ্বংস
পলাশীর যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার কৃষি এবং তার শিল্পের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। কৃষকদেরকে নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদনে এবং তা কম দামে তাদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে তাঁতীদেরকে জোরাজুরি করে অধিক পরিমাণ মসসলিন বুনতে বাধ্য করত এবং বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে তারা কিনে নিত। এ অবস্থায় তাতীরা মসলিন বুনতে না চাইলে তাদের আঙ্গুল কাটা হত।
অর্থ-সম্পদের লুণ্ঠন ও পাচার
বাংলার মসনদে বসে মিরজাফর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও রবার্ট ক্লাইভকে প্রচুর অর্থ ও বিভিন্ন উপঢৌকন দান করেন। ক্লাইভ কে ২ লক্ষ ৩৪ হাজার পাউন্ড এবং কলকাতা কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্যকে ৫০ হাজার পাউন্ড করে দেয়া হয়। ফলে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়।কোম্পানি নবাবের কাছ থেকে ২৪ পরগনার জমিদারি স্বত্ব নিয়ে নেয়। তাছাড়াও কোম্পানি বিভিন্ন উপায়ে বাংলার আর্থিক সম্পদ শোষণ করতে থাকে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারাট বলেছেন যে, বাংলার মানুষের শেষ রক্তবিন্দু শুষে না নেওয়া পর্যন্ত ইংরেজরা তাদের শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। এই ঘটনাকে ‘পলাশীর লুন্ঠন‘ বা ‘Plassey Plunder’ বলা হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি
কোম্পানির ক্ষমতা গ্রহণ একদিকে বেদনাদায়ক হলেও বাই প্রোডাক্ট হিসেবে এ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে।
সামাজিক গতিশীলতা
মুঘল আমলের সমাজ ব্যবস্থা ছিল স্থবির পলাশীর যুদ্ধের পর এদেশে ইরোপীয় ভাবধারার উপ-বেশ ঘটে ফলে সমাজে গতিশীলতা আসে। রেনেসাঁপ্রসূত ইউরোপীয় আবিষ্কার সমাজ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে থাকে।
বঙ্গীয় রেনেসাঁর সূত্রপাত:
পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশে ইউরোপীয় আধিপত্যবাদের সূচনা হলে শিক্ষা সংস্কৃতি যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয়। বাংলায় আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটে যা ভারতময় ছড়ানো থাকে। ইউরোপীয় জীবন ব্যবস্থা, সামরিক কৌশল, সমরাস্ত্র, উন্নত কূটনীতি, আধুনিক আইন-কানুন, শিক্ষা, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে দারুন পরিবর্তন শুরু হয় যা বঙ্গীয় রেনেসাঁর সূত্রপাত করে।
পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার
পরাজয়ের কারণ
মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা
পলাশীর যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের প্রধান কারণ।
নবাবের অদূরদর্শীতা:
নবাব সিরাজউদ্দৌলার ও দূরদর্শিতা তার পরাজয়ের বড় কারণ ইতিপূর্বে মীরজাফর বেশ কয়েকবার অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিলেন। মীরজাফর ষড়যন্ত্রকারী বুঝতে পারলেও তাকে তিনি সেনাপতির পথ থেকে অবসর করেননি। আলিনগরের সন্ধি এবং ইংরেজদের প্রতি তোষণ নীতি তার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। তিনি যদি দৃঢ়তার সাথে মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, ঊমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ গংদেরকে শাস্তি বিধান করতেন তাহলে তাঁর পরাজয় বরণ করতে হতো না।
মীর মদনের মৃত্যু
মীর জাফর নিষ্ক্রিয় থাকলেও মীর মদন অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে মীরমদনের হঠাৎ মৃত্যু যুদ্ধের গতি পাল্টে দিয়েছে।
অসময়ের যুদ্ধ বন্ধ করা
সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরের মিথ্যা শপথ এবং কুচক্রীদের পরামর্শে অসময়ে যুদ্ধ বন্ধ করে বড় ভুল করেছিলেন। তিনি যদি মোহনলাল এর পরামর্শ মত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতেন তাহলে হয়তো যুদ্ধের ফলাফল বিপরীত হতে পারত।
হিন্দুদের বিরোধিতা
মীর মদন এবং মোহনলাল এর মত কিছু দেশ প্রেমিক ছাড়া অধিকাংশ হিন্দু অভিজাত এবং বেনিয়ারা ছিল মুসলিম শাসনের বিরোধী। তারা কখনোই মনে প্রানে মুসলিম শাসন গ্রহণ করেনি। তাদের এই বিরোধিতা ইংরেজদের অনুপ্রাণিত করেছে।
রাজ কর্মচারীদের অবিশ্বস্ততা
নবাবের বড় বড় রাজ-কর্মচারী যেমন জগৎশেঠ রাজবল্লভসহ রায় দুর্লভ উমিচাঁদ প্রমুখ ছিল ষড়যন্ত্রের মূল হোতা। তাদের অবিশ্বস্ততা নবাবের পরাজয়ের কারণ।
নবাবের নৌ বাহিনীর অভাব:
বাংলার নবাবদের নৌ বাহিনী না থাকায় ইউরোপিয়ান শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। নবাব কলকাতা থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করলেও জাহাজে করে তারা ভাগীরথী নদীতেই ছিল। রবার্ট ক্লাইভ এবং ওয়াটসন যখন কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন তখন তাদেরকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো নৌ শক্তি নবাবের ছিল না।
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
আরও পড়ুন-
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ।। Shah Wali Ullah
আরও পড়ুন-
নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:
এ কে এম আব্দুল আলীম, ভারতের মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা, নবম মুদ্রণ, 2015
ডঃ মো: শাহজাহান, বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৭৬৫, তূর্য প্রকাশন ঢাকা, ২০১৩
মোঃ আব্দুর রহিম বাংলার ইতিহাস
প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম, বাংলার ইতিহাস. ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো https://www.dailyinqilab.com/article/26563/
https://www.onnoekdiganta.com/article/detail/12237
https://www.gkpathya.in/2021/11/battle-of-plassey.html
https://adhunikitihas.com/battle-of-plassey/
No comments:
Post a Comment