Breaking

Tuesday 28 February 2023

সম্রাট জাহাঙ্গীর এর রাজত্বকাল এবং তাঁর উপর নুরজাহানের প্রভাব

 

সম্রাট জাহাঙ্গীর এর রাজত্বকাল এবং তাঁর উপর নুরজাহানের প্রভাব

(১৬০৫-১৬২৭)

জন্ম ও পরিচিতি:

সম্রাট জাহাঙ্গীরের মূল নাম সেলিম।  সেলিমের জন্ম ১৫৬৯ সালে রানী যোধাবাঈ এর গর্ভে। একাধিক শিশু সন্তানের মৃত্যু হওয়ায় উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্র লাভের আশায় আকবর প্রতিবছর আজমিরে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর দরগা জিয়ারত করতেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। একই উদ্দেশ্যে সম্রাট প্রত্যেক সপ্তাহে ফতেপুর সিক্রির বিখ্যাত সাধক শেখ সেলিম চিশতীর দরবারে গমন করতেন। আকবর ধারণা করেন যে সাধক সেলিম চিশতীর দোয়ার বরকতেই তার স্ত্রীর গর্ভে পুত্র সন্তান এসেছে। সুফি সাধকের নাম অনুসারে আকবর তার ছেলের নাম রাখেন সেলিম। আকবর সেলিমকে আদর করে ডাকতেন ‘শেখু বাবা’।অনেক প্রার্থনার পর এই সন্তান লাভ করার কারণে সেলিমকে বলা  হয় ”A Son of Many Prayer”। 



 



বিবাহ

১৫৮৬ সালে  যুবরাজ সেলিম ভগবান দাসের কন্যা মানবাঈকে বিবাহ করেন। 



আকবর ও সেলিমের মধ্যে মনমালিন্য

সম্রাট আকবরের শেষ জীবন ছিল নিঃসঙ্গতায় পরিপূর্ণ। বন্ধু ও রাজকবি ফৈজি ১৯৯৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন অত্যাধিক মদ্য পানের কারণে পুত্র মুরাদ  1599 সালে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্র দানিয়াল মৃত্যুবরণ করেন ১৬০৪ সালে। ১৬০১ সালে  আদরের পুত্র সেলিম বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। সেলিম কৌশলে 1602 সালে সম্রাট আকবরের অত্যন্ত আস্থাভাজন আবুল ফজলকে হত্যা করান। এভাবে প্রিয় দুই পুত্র ও রাজনৈতিক সঙ্গীদেরকে হারিয়ে আকবর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।পুত্র সেলিম বিদ্রোহ করলে আকবর সেলিমের পরিবর্তে তার পুত্র এবং সম্রাটের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও প্রিয়পাত্র আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, মনোমুগ্ধকর চরিত্রের অধিকারী খুসরুকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। 



উত্তরাধিকারী মনোনয়ন:

খসরুকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী করা হবে  সম্রাটের  এইরকম মনোভাবের ফলে সেলিম অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। সেলিম পিতার কাছে ক্ষমা প্রার্থী হন। ১৬০৩ সালে রাজমাতা শলিমা সুলতানার মধ্যস্থতায় পিতা পুত্রের মাঝে সমঝোতা হয় এবং ১৬০৪ সালে আকবর পুত্র সেলিমকে ক্ষমা করে তার পরবর্তী উত্তররাধীকারী  মনোনীত করেন।



আরও পড়ুন-




ক্ষমতায় আরোহন 

সম্রাট আকবরের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে ১৬০৫ সালের ২৪ অক্টোবর তার পুত্র যুবরাজ সেলিম ৩৬ বছর বয়সে আগ্রাতে ‘নুরু উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশা গাজী’ উপাধি ধারণ করে দিল্লির মুঘল সিংহাসনে আরোহন করেন।


প্রাথমিক কার্যাবলী

জনসমর্থন লাভের চেষ্টা

মুঘল সিংহাসনে আরোহন করার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর সাম্রাজ্যের জনসাধারণের মন জয় করার জন্য এবং জনপ্রিয় শাসক হওয়ার লক্ষ্যে জনহিত কর কার্যাবলীর দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম জনসাধারণকে মুক্ত হস্তে দান করে সকলের প্রিয়ভাজন হওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেন এবং তার পিতার আমলের রাজকীয় কর্মচারীদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেন।


সোনার শিকল স্থাপন:

তুজুক ই জাহাঙ্গীরী এর ভাষ্য অনুযায়ী সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ৩০ গজ লম্বা ৬০ টি ঘন্টা বিশিষ্ট একটি সোনার শিকল আগ্রার দুর্গের শাহবুরুজি থেকে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত একটি লোহার নির্মিত স্তম্ভের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন। যে কোনো ব্যক্তি বিচার প্রার্থনা করে এই শিকল টানলেই সম্রাট তার প্রার্থনা শোনার ব্যবস্থা করতেন। সম্রাটের এই সোনার শিকল ঝুলানোর পিছনে তার সততা ও ন্যায়-পরায়ণতা সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পাওয়া যায়। এই শিকলটির ওজন ছিল ইরাকি ৪২ মন এবং ভারতীয় ৪ মন। 



দস্তুরুল আমল

ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই সম্রাট জাহাঙ্গীর সাম্রাজ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং জনগণের সন্তুষ্টি ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য বারটি আইন সম্বলিত একটি ঘোষণা জারি করেন যা দস্তুরুল আমল নামে পরিচিত।


  1. বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত ও অবৈধ শুল্ক রহিত করণ; 

  2. দস্যুবৃত্তি চুরি-ডাকাতি নিয়ন্ত্রণ;

  3. মৃত ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার নির্ণয়;

  4. মদ ও অন্যান্য উত্তেজক পানীয় সেবন ও বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ;

  5. জোরপূর্বক অন্যের সম্পত্তি দখল নিষিদ্ধকরণ; 

  6. অপরাধের শাস্তি হিসেবে অঙ্গচ্ছেদ তথা নাক ও কর্ণ ছেদন নিষিদ্ধকরণ এবং বলপূর্বক ঘরবাড়ি দখল নিষিদ্ধকরণ;

  7. রবিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন;

  8. আর্তপীড়িতের  সেবায় হাসপাতাল নির্মাণ ও চিকিৎসক নিয়োগ;

  9. মনসব ও জায়গীর প্রথার স্থিতিশীলতা বিধান; 

  10. আইমা তথা ওয়াকফ জমি অনুমোদন;

  11. নির্দিষ্ট দিনে পশুহত্যা নিষিদ্ধকরণ;

  12. দুর্গ ও কারাগারে সকল বন্দিদের প্রতি রাজনৈতিক ক্ষমা প্রদর্শন। 




আরও পড়ুন-



সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে আমাদেরকে বেশ কিছু চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন- 





সম্রাট জাহাঙ্গীরের চার পুত্র 

  1. খসরু 

  2. পারভেজ 

  3. খুররম (শাহজাহান)

  4. শাহরিয়ার

সম্রাজ্ঞী

নুরজাহান (মেহেরুন্নেসা)

নুরজাহানের ভাই

আসফ খান

নুরজাহানের বাবা

মির্জা গিয়াস বেগ

নুরজাহানের আগের পক্ষে কন্যা

লাডলী বেগম

নুরজাহানের পূর্বের স্বামী

আলীকুল ইস্তাজুল ওরফে শের আফগান

আসফ খানের কন্যা

আরজুমান্দু বানু বেগম ওরফে মমতাজ মহল

শাহজাহান বিবাহ করেন

মমতাজকে (আসফ খানের মেয়ে, নুরজাহানের ভাতিজি

শাহরিয়ার বিবাহ করেন

লাডলি বেগমকে (নুরজাহানের আগের পক্ষে কন্যা) 

সেনাপতি

মোহাব্বত খান




  1. শাহজাদা খসরুর বিদ্রোহ: 

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে সেলিম এবং আকবরের মনোমালিনের কারণে আকবর সেলিমের পুত্র খুসরুকে পরবর্তী উত্তরাধিকারী মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। রাজ সিংহাসনের যে স্বপ্ন খসরু দেখেছিলেন তা হয়তো তিনি ভুলতে পারেননি। যুবরাজ খুসরু সাম্রাজ্যের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় ব্যক্তি ছিলেন। তার চারিত্রিক মাধুর্য তার জনপ্রিয়তার বিশেষ কারণ ছিল। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় জাহাঙ্গীরের ক্ষমতা লাভের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় খুসরু বিদ্রোহ করেন। খসরু পাঞ্জাবে পলায়ন করেন এবং সেখান থেকে লাহোর দুর্গ অধিকারের চেষ্টা করেন। মথুরার হোসেন বেগট, লাহোরের আব্দুল আজিজ এবং শিখ গুরু অর্জুন তাকে সহায়তা করেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী পুত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করেন। পলায়নরত খসরু কাবুলে গমনকালে তার অনুসচরবর্গসহ বন্দী হন। হাত-পা শৃঙ্খিত অবস্থায় খুসরুকে রাজ দরবারে প্রকাশ্যে উপস্থিত করা হলে সম্রাট তাকে তীব্র ভৎসনা করেন।  অতঃপর কারারুদ্ধ অবস্থায় খসরুকে আংশিকভাবে অন্ধ করে সিংহাসনের জন্য অযোগ্য করে ফেলা হয়। 


দশ বছর কারারুদ্ধ থাকার পর জাহাঙ্গীরের আদেশে খুসরুকে মুক্তি দেয়া হয়। 1620 সালে খসরুকে খুররমের (শাহজাহানের) তত্তাবধানে রাখা হয়। ১৬২২ সালে খসরু মারা যান। প্রচার করা হয় যে খুসরু পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে এ কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু ভিন্ন মতে শাহজাদা খুররম (শাহজাহান) রাজা বাহাদুর নামে এক দুর্বৃত্তের মাধ্যমে খুসরুকে হত্যা করিয়েছেন। 


এই হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে সম্রাটের তৃতীয় পুত্র খুররম সিংহাসনের দাবিদার ছিলেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে ইতিমধ্যেই মনোনীত উত্তরাধিকারী পারভেজ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। ফলে  খুররমের সামনে রাজ সিংহাসনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন অন্ধ প্রায় খসরু। তাই খুসরুকে সরিয়ে খুররম তার সিংহাসন লাভের পথ নিষ্কন্টক করেছেন। 



  1. শিখ গুরু অর্জুনকে হত্যা

খসরুর সহযোগী হোসেন বেগ এবং আব্দুল আজিজকে অমানুষিক শাস্তি দিয়ে হত্যা করা হয়। আরেক সহযোগী শিখ গুরু অর্জুন খসরুকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছিলেন। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে সম্রাট জাহাঙ্গীর খসরুকে বড় ধরনের আর্থিক জরিমানা করেন। শিখ গুরু অর্জুন অপরাধ স্বীকার না করে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেন এবং জরিমানার অর্থ দিতে অস্বীকার করেন। ফলে সম্রাট জাহাঙ্গীর অর্জুনকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। উল্লেখ্য যে কোন ধর্মীয় কারণে নয় বরং রাষ্ট্রদ্রোহী এবং বিদ্রোহীকে সাহায্য করার জন্যই অর্জুনকে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের ফলে শিখ জাতি মুঘলদের চিরশত্রুতে পরিণত হয়। 



আরও পড়ুন-





  1. সম্রাট জাহাঙ্গীর ও  সম্রাজ্ঞী নুরজাহান

সম্রাট জাহাঙ্গীর 1611 সালে মেহের-উন-নিসা নামে এক অনন্য সুন্দরী রমণীকে বিবাহ করেছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের প্রায় ১৫ বছর যাবত এই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রমণী সম্রাটের জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। 


  1. নুরজাহানের পরিচিতি:

নুরজাহানের প্রকৃত নাম মেহের-উন- নিসা। ঐতিহাসিক মুতামিদ খানের ইকবাল নামার বর্ণনা অনুযায়ী মেহেরুন্নিসা ইরানি মির্জা গিয়াস বেগের কন্যা। আকবরের রাজত্বকালে পরিবারবর্গসহ মির্জা গিয়াস বেগ ভাগ্যান্বষণে ভারতে আসেন। ইতিমধ্যে কান্দাহারে মেহেরুন নিশার জন্ম হয় মির্জা গিয়াস ব্যাগ সম্রাট আকবরের রাজদরবারে চাকরি লাভ করেন। মেহেরুন্নেসার অপূর্ব সৌন্দর্য  শাহজাদা সেলিমকে মুগ্ধ করে।  


  1. মেহেরুন্নিসার বিবাহ:

যুবরাজ সেলিমের গোপন প্রণয়ের সংবাদ সম্রাট আকবর অবগত হলে মেহেরুন্নেছার সাথে শাহাজাদা সেলিমের যাতে কোন সম্পর্ক না থাকে সেজন্য পারসিক ভাগ্যান্বেষী যুবক আলীকুলি ইস্তাজুলের সাথে তার বিবাহ দেন। 


আলীকুলি ইস্তাজুল বর্ধমান অঞ্চলে জায়গীরদারী লাভ করেন। তিনি শের আফগান উপাধিতে ভূষিত হন। অল্পকালের মধ্যে আলী কুলি ইস্তাজুল শক্তিশালী ও ঔদ্ধত্য হয়ে বিদ্রোহ করলে সম্রাট জাহাঙ্গীর তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন। যুদ্ধে শের আফগান পরাজিত ও নিহত হন। 


  1. মুঘল দরবারের মেহেরুন্নিসা:

বিধবা এবং নিরাশ্রয়া মেহেরুন্নিসাকে সম্রাটের আদেশে তার শিশু কন্যা লাডলী বেগমসহ মুঘল দরবার নিয়ে আসা হয়। তাকে আকবরের এক বিধবা রমণী বেগম রোকেয়া সুলতানার তত্ত্বাবধানে কিছুকাল রাখা হয়। 


  1. জাহাঙ্গীরের সাথে বিবাহ:

এই ঘটনার চার বছর পর ১৬১১ সালে নওরজ উৎসবে এক মীনা বাজারে সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নেসাকে দেখতে পেয়ে তার তার রূপ ও সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হন। ১৬১১ সালের শেষ দিকে সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসাকে  বিবাহ করে প্রধান বেগমের মর্যাদা দেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসাকে প্রথমে নুরমহল অতঃপর নুরজাহান উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর মুঘল রাজদরবারে নুরজাহানের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। 


অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন জাহাঙ্গীর (সেলিম) পূর্ব থেকেই  মেহেরুন্নিসার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। সম্রাট হওয়ার পরবর্তীকালে শের আফগানকে হত্যা করাইয়া তিনি মেহেরুন্নিসাকে রাজ দরবারে এনে অনেক সাধ-সাধনার দ্বারা তাকে  সম্মত করিয়ে বিবাহ করেন। কিন্তু ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে নীরব থাকায় ঐতিহাসিক বেণী প্রসাদ এই ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। 


কিছু কিছু ঐতিহাসিক আকবরের রাজ দরবারে তুর্কি সুলতান কর্তৃক প্রেরিত আনারকলি নামক এক নর্তকীর সাথে গোপন প্রণয়ের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে জাহাঙ্গীর গোপন প্রণয়ের উর্ধ্বে ছিলেন না বলে মনে করেন। শের আফগানের মৃত্যুর পর মেহেরুন্নিসাকে তার পিতার কাছে না নিয়ে কেন রাজ দরবারে নিয়ে আসা হয়েছিল এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি। অবশ্য মেহেরুুন্নছার প্রতি যদি শাহজানের আকর্ষণই থাকবে তাহলে ১৬০৭ সালে তার বিধবা হওয়ার পর চার বছর বিলম্ব করে কেন ১৬১১ সালে জাহাঙ্গীর বিবাহ করবেন এই প্রশ্নেরও  কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।  



  1. নুরজাহানের কৃতিত্ব:

নুরজাহান শুধু অসামান্য রূপবতী মহিলাই ছিলেন না ফার্সি, সাহিত্য, কবিতা প্রভৃতিতে ও তার অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল। শিল্পের প্রতি অনুরাগ, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন নুরজাহান। নিত্য নতুন ডিজাইনের পোশাক ও অলংকার আবিষ্কারে তার জুড়ী ছিল না। ৩৪ বছর বয়সেও তার সৌন্দর্য এতটুকু ম্লান হয়নি।মুঘল দরবারের শ্রী বৃদ্ধিতে তার বেশ অবদান ছিল। অসহায় ও নির্যাতিতা বালিকাদের আশ্রয়দাত্রী ছিলেন নুরজাহান। অনাথা মেয়েদের বিবাহের জন্য তিনি অর্থ দান করতেন। সম্রাটের সাথে তিনি প্রায়ই বাঘ শিকারে বের হতেন। রাজনৈতিক দৃষ্টি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল তার চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। 


  1. সম্রাট জাহাঙ্গীরের উপর নূরজাহানের প্রভাব

নূরজাহান নিজস্ব রূপ লাবণ্য ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সম্রাট জাহাঙ্গীরের ওপর পুরােপুরি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যে নূরজাহানের ক্ষমতাই সর্বোচ্চ হয়ে দাঁড়ায়। নুরজাহানের ভাই আসফ খান এবং পিতা মির্জা গিয়াস বেগ রাজ দরবারের উচ্চপদে আসীন হন। পিতা গিয়াস ব্যাগ অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে ইতিমাদ-উদ-দৌলা উপাধিতে ভূষিত হন। ফলে জাহাঙ্গীর ক্রমশ আরামপ্রিয় হয়ে বিলাসিতায় নিমজ্জিত হন। অন্যদিকে নূরজাহান দিন দিন অভিজ্ঞতা ও শক্তির অধিকারী হতে থাকেন এবং সম্রাটের নামের সাথে তার নামও মুদ্রায় অঙ্কিত হয়। এমনকি সব সরকারি ফরমানে জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষরের সাথে নুরজাহানের দস্তখতও থাকত। শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর নূরজাহানের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন। জাহাঙ্গীর একদা বলেছিলেন-আমি তো এক পেয়ালা মদ এবং এক ডিস সুপের বিনিময়ে আমার সাম্রাজ্য প্রিয়তম স্ত্রীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছি


নুরজাহান তার প্রথম পক্ষের কন্যা লাডলী বেগমের সাথে কনিষ্ঠ যুবরাজ শাহরিয়ারের বিবাহ দিয়ে ভবিষ্যৎ সম্রাটের পদটি করায়াত্তর করার চেষ্টা করেন। এদিকে ১৬১২ সালে নুরজাহানের ভাতা আসফ খান তার কন্যা আরজুমান্দ বানু বেগম এর সাথে যুবরাজ খুররম (শাজাহানের) বিবাহ দেন। ফলে ভবিষ্যৎ সম্রাটের পদটি দখলের জন্য ভাই-বোনের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করে। ঐতিহাসিক ভিন্সেন্ট স্মিথ নুরজাহানকে সিংহাসনের পশ্চাত্যের শক্তি বলে অভিহিত করেন। নুরজাহান ও তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রভাব প্রতিপত্তির ফলে ক্রমে রাজসভার অন্যান্য অভিজাতবর্গের মনে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর নানাবিধ বিপদের সম্মুখীন হন।   


  1. রাজনীতি থেকে অবসর ও মৃত্যু

নুরজাহানের অতিরিক্ত ক্ষমতার চর্চার কারণে সেনাপতি মহাব্বত খান এবং যুবরাজ শাহজানের সাথে তার মনোমালিন্য ঘটে। মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী নিয়ে শাহরিয়ার এবং শাহজাহানের  ভাতৃদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আসফ খানের সহায়তায় খুররম তথা শাজাহান এই দ্বন্দ্বে জয়লাভ করলে 1627 সালে শাহজাহানের মৃত্যুর পর নুরজাহান রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অতঃপর কন্যা লাডলি বেগমকে নিয়ে তিনি লাহোরে সাধারণ জীবন যাপন করেন। ১৬৪৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। 



আরও পড়ুন-


 


  1. সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজ্য বিস্তার

  1. মেবার বিজয় ১৬১৫

মেবারের রানা প্রতাপ সিংহের পুত্র অমর সিংহ মেবারের স্বাধীনতা রক্ষায় সচেষ্ট  ছিলেন।  বশ্যতা স্বীকার না করার কারণে  মেবারের বিরুদ্ধে সম্রাট জাহাঙ্গীর আকবর অনুসৃত যুদ্ধনীতি গ্রহণ করেন। শাহজাদা পারভেজ সেনাপতি মহাব্বত খান এবং আব্দুল্লাহ খান এর নেতৃত্বে মেবারের বিরুদ্ধে প্রেরিত অভিযানগুলো ব্যর্থ হয়। ১৬১৫ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর তৃতীয় পুত্র খুররমের নেতৃত্বে মেবারে সামরিক অভিনন্দন প্রেরণ করেন। শাহজাদা খুররমের হাতে অমর সিংহএবং তার পুত্র কিরণ সিংহ পরাজিত হয়ে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য শিকারে বাধ্য হন। উদারনীতি অনুসরণ-পূর্বক বিজিত শত্রুর প্রতি জাহাঙ্গীর উপযুক্ত মর্যাদা প্রদর্শন করেন। অমর সিংহকে চিতোর ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং কিরণ সিংহকে ৫ হাজারী মনসবদার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মেবারের বশ্যতা স্বীকারে সম্রাট জাহাঙ্গীর অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে অমর সিংহ এবং কিরণ সিংহের মর্মর মূর্তি স্থাপন করে আগ্রার উদ্যানে স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।   



 

  1. নাগরকোট দুর্গ জয় ১৬২০:

পাঞ্জাবের শাসনকর্তা মুর্তজা খান কাংড়া তথা নাগরকোট দুর্গ অধিকার করতে ব্যর্থ হলে শাহজাদা খুররমের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের দুর্ভেদ্য নাগরকোট/কাংড়া দুর্গ দীর্ঘকাল অবরোধের পর ১৬২০ সালে অধিকার করতে সমর্থ হন। 

 

  1. দাক্ষিণাত্য অভিযান 1617:

পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে সম্রাট জাহাঙ্গীর দাক্ষিণাত্যে সামরিক অভিযান প্রেরণ করলেও  আহম্মদ নগরের শক্তিশালী মন্ত্রী মালিক অম্বর এর প্রতিরোধের কারণে মুঘল বাহিনী ব্যর্থ হয়। মালিক অম্বর মোগল শক্তিকে প্রতিহত করতে দুর্ধর্ষ মারাঠা সৈনিকদেরও ব্যবহার করেন। দাক্ষিণাত্যে মুঘলদের অযোগ্যতার সুযোগ মালিক অম্বর আহমেদনগর এর মুঘল অধিকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন।  


অবশেষে ১৬১৭ সালের সম্রাট জাহাঙ্গীর তৃতীয় পুত্র শাহজাদা খুররমকে মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। শাহজাদা খুররম মালিক অম্বরকে পরাজিত করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আহমদ নগর দুর্গ অধিকার করেন। আহমদনগরের পতন এবং মালিক অম্বর এর পরাজয়ের সংবাদে সম্রাট জাহাঙ্গীর অত্যন্ত প্রীত হয়ে পুত্র খুররমকে শাহজাহান (পৃথিবীর রাজা)  উপাধিতে ভূষিত করেন।

কিন্তু মোগলদের দাক্ষিণাত্য বিজয় স্থায়ী হয়নি। মোগলদের আন্তঃ দ্বন্দ্বের সময়ে মালিক অম্বর পুনরায় মুঘল অধিকৃত স্থানগুলো দখল করেন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মালিক অম্বরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মুঘলদের প্রতিরোধ করে যাচ্ছিলেন। 

 


  1. কান্দাহার হারানো:

১৬২২ খ্রিস্টাব্দে আকস্মিকভাবে পারস্য সম্রাট শাহ আব্বাস মোগল সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত কান্দাহার আক্রমণ করে তা দখল করেন।সম্রাট জাহাঙ্গীর তার সর্বাপেক্ষাযোগ্য পুত্র শাহজাহানকে কান্দার পুনরুদ্ধারে  প্রেরণ করতে চাইলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে সাম্রাজ্ঞী নুরজাহান ছোট শাহজাদা শাহারিয়ার কে পরবর্তী সম্রাট করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন। শাহরিয়ারকে ক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমে তিনি স্বামীর মৃত্যুর পরেও যাতে সিংহাসনের অন্তরালে থেকে তার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। শাহজাহানকে দূরবর্তী প্রদেশ কান্দাহারে প্রেরণ করে নুরজাহান তার স্বার্থ হাসিল করবেন এই বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শাহাজাহান কান্দাহারে যেতে অস্বীকার করেন। শাহজাহান বিদ্রোহ করলে সম্রাট জাহাঙ্গীর কান্দাহার পুনরুদ্ধারের আশা পরিত্যাগ করেন। 




  1. জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ

  1.  বাংলায় বিদ্রোহ:

১৫৭৫ সালে আকবর বাংলা অধিকার করলেও বাংলার আফগান দলপতিগণ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভূত্ব স্বীকার করেননি। সম্রাট জাহাঙ্গীর কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার সুবেদার ইসলাম খানের বিরুদ্ধে আফগান অভিজাতবর্গ বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন । আফগান নেতা ঈসা খানের পুত্র ওসমান খানের নেতৃত্বে বাংলায় বিদ্রোহ দেখা দিলে ১৬১২ সালে বিদ্রোহী নেতা ওসমান খানকে পরাজিত ও হত্যা করে বাংলার বিদ্রোহ দমন করা হয়। 



  1.  শাহজাহানের বিদ্রোহ:

সম্রাজ্ঞী নুরজাহানের চক্রান্তই শাহজাহানের বিদ্রোহের একমাত্র কারণ। সম্রাটকে ক্রিড়নকে পরিণত করে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে শাহরিয়ারকে বসানোর জন্য নুরজাহানের পরামর্শে সম্রাট জাহাঙ্গীর শাহজাহানকে দূর দেশ কান্দাহারে পাঠাতে চেয়েছিলেন বলে শাহজাহান মনে করেন। বিমাতার ক্রিড়নক  পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই শাহজাহান স্থির করলেন। মুঘল রাজকর্মচারী আব্দুর রহিম খান-ই-খানানের সহায়তায় বিদ্রোহী শাহজাহান প্রথমে আগ্রা দখল করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পারভেজ ও মহব্বত খানের হাতে ১৬২৩ সালে তিনি পরাজিত হন। অতঃপর তিনি দাক্ষিণাত্যে গমন করেন। সেখান থেকে বাংলায় এবং পুনরায় দাক্ষিণাত্য  আশ্রয়ের জন্য ঘুরে বেড়ান। শাহাজাদা পারভেজ ও মহব্বত খান দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হলে শেষ পর্যন্ত শাহজাহান আত্মসমর্পণ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর শাহজাহান কে ক্ষমা করেন। এভাবে জাহাঙ্গীরের নিরর্থক বিদ্রোহের অবসান ঘটে। 


  1. সেনাপতি মহাব্বত খানের বিদ্রোহ:

সেনাপতি মহব্বত খান অত্যন্ত বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী ছিলেন এবং রাজ্যের নিরাপত্তা বিধানে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। পারভেজ এবং মহব্বত খান অত্যন্ত শক্তিশালী ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠতেছেন দেখে নুরজাহান ও তার ভাই আসফ খান মোহাব্বত খানের ধ্বংস সাধনে বদ্ধপরিকর হন। নুরজাহান প্রথমে মহব্বত খানকে মুঘল সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ত্যাগ করে বাংলার শাসনভার গ্রহণের আদেশ দেন। আপত্তি ও দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও মহব্বত খান সে আদেশ পালন করেন। অতঃপর নুরজাহান মহাব্বত খানের বিরুদ্ধে তহবিল তসরুপ ও দুর্নীতির অভিযোগ আনেন এবং মহব্বত খানের কন্যাকে সম্রাটের বিনা অনুমতিতে বিবাহ না দেওয়ার নির্দেশ দেন। নুরজাহানের এইরকম ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত মহব্বত খান বিদ্রোহ করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাবুল যাওয়ার পথে মহব্বত খান নুরজাহানসহ সম্রাটকে বন্দী করেন। নুরজাহান অতি কৌশলে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে অসাধারণ সাহস ও উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সম্রাটকেও উদ্ধার করেন। মুক্ত সম্রাট একদল সৈন্য সংগ্রহ করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে অতঃপর উপায়ান্তর না দেখে মোহাব্বত খান দাক্ষিণাত্যে শাহজাহানের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেন। 


এদিকে ১৬২৬ সালে শাহজাদা পারভেজ মৃত্যুবরণ করেন। পারভেজ ছিলেন অত্যাধিক মদ্যপায়ী এবং অভ্যাসগত মাতাল। ফলে মুঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে শাহজাহান এবং শাহরিয়ার অবশিষ্ট রইলেন।    



আরও পড়ুন-

সম্রাট আকবরের সামরিক নীতি এবং মনসবদারী প্রথা




  1. জাহাঙ্গীরের মৃত্যু ও উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব:

১৬২৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হয়। ইতিপূর্বে  খসরু ও পারভেজের মৃত্যু হয়েছিল। ফলে মুঘল সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে শাহজাহান এবং শাহরিয়ারের মধ্যে ভাতৃদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই ভাতৃদ্বন্দ্বে আসফ খানের সহায়তায় নূরজাহানের পরাজয় ঘটে এবং শাহজাহান শাহরিয়ার কে পরাজিত ও হত্যা করে মোগল সিংহাসনে আরোহন করেন। 


  1. ইউরোপিয়ানদের সাথে জাহাঙ্গীরের সম্পর্ক

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে অনেক ইউরোপিয়ান বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য তার আনুকূল্য লাভের চেষ্টা করেছেন। পর্তুগিজদের নানাবিধ অপকর্মের কারণে তাদের সাথে মুঘলদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল অন্যদিকে ১৬০৮ সালে ক্যাপ্টেন হকিংন্স ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের নিকট থেকে অনুরোধ পত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য এসেছিলেন। পর্তুগিজদের বিরোধিতার কারণে তিনি সফল না হলেও 1615 সালে ইংল্যান্ডের রাজা জেমস পুনরায় স্যার টমাস রো নামক ব্যক্তিকে বানিজ্যিক  সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য মুঘল দরবারে প্রেরণ করেন। এবং টমাস রো নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত বাণিজ্যিক ফরমান লাভ করেন। 


  1. জাহাঙ্গীরের চরিত্র চরিত্র ও কৃতিত্ব:

মুঘল ইতিহাসে জাহাঙ্গীর ছিলেন সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে অন্যতম। তার সমসাময়িক  জীবনী লেখকদের মতে জাহাঙ্গীর ছিলেন সুবুদ্ধি সম্পন্ন, সুবিবেচক, দয়ালু, আত্মীয়-বর্গের প্রতি নিষ্ঠাবান, সকলের প্রতি অকুণ্ঠভাবে উদার, অত্যাচারের প্রতি ঘৃণা সম্পন্ন এবং ন্যায় বিচারের প্রতি আগ্রহশীল।  সমসাময়িক অ্যাডওয়ার্ড টেরি জাহাঙ্গীরকে চরমপন্থী বলেছেন। ঐতিহাসিক বেভারিজ জাহাঙ্গীরকে বৈপরীত্যের সংমিশ্রণ বলে আখ্যা দেন। অর্থাৎ তার চরিত্রে ছিল বিপরীত গুণাবলীর সমষ্টি। নিষ্ঠুরতা, কোমলতা, কঠোরতা, স্নেহ প্রবণতা এবং ন্যায়বিচার ও খেয়ালিপনার অদ্ভুত সংমিশ্রণ হয়েছিল তার চরিত্রে।  



ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে কেউ তাকে গোড়া সুন্নি, কেউ তাকে বলেছেন সর্বেশ্বরবাদী, কেউ বলেছেন নাস্তিক, কেউ কেউ তাকে যীশুখ্রীষ্টের প্রচারিত বানীর প্রতি বিশ্বাসী এবং কেউ বলেছেন তিনি ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি বিদ্রুপকারী। তবে এসব সর্বৈব সত্য নয়।  তিনি পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন এবং  স্রষ্টার  প্রতি তার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল।


জাহাঙ্গীরের শাসনকাল প্রথম দিকে কর্তৃত্ববাদী হলেও শেষ দিকে তা ছিল না। আর তার শাসনকালের মধ্যে ১৫ বছর নুরজাহান পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন। তবে রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ছিলেন না। সামরিক ক্ষেত্রে তিনি খুব বেশি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি। তবে নিরপেক্ষভাবে তিনি বিচার কার্য সমাধান করতেন। ধনী-দরিদ্র সকলেই তার দৃষ্টিতে সমান ছিল। সাহিত্যের প্রতি তার গভীর অনুরাগ ছিল। তিনি সাহিত্য ও শিল্পে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। অনেকে তার শাসনকালকে  ভারতীয় সাহিত্যের অগাস্টাসের যুগ বলে অভিহিত করেন। 


  1. তুজুক ই জাহাঙ্গীরী:

জাহাঙ্গীর নিজে কবি, সাহিত্যিক ও চিত্রকর ছিলেন। তুজুক ই জাহাঙ্গীরী সম্রাট জাহাঙ্গীরের লেখা আত্মজীবনী। এটি তার সাহিত্য কীর্তির উজ্জ্বলতম নিদর্শন। তুজুক ই জাহাঙ্গীরী মুঘল ইতিহাসের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 





আরও পড়ুন-

আরও পড়ুন-

আরও পড়ুন-

বক্সারের যুদ্ধ  এবং  নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান 










সহায়ক গ্রন্থাবলী

এ.কে.এম.আবদুল আলীম, ভারতে মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস 




Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.




No comments:

Post a Comment