Breaking

Sunday 5 March 2023

সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল: মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ


সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল:

মুঘল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ 


পরিচিতি ও উত্থান

জন্ম         : ১৫৯২ সালে 

প্রকৃত নাম : খুররম উপাধি শাহজাহান 

মাতা : জগৎ গোসাই 

বিবাহ : ১৬১২ সালে আসফ খানের কন্যা আরজুমান্দ বানু বেগমকে 

শাহজাহান উপাধি : দাক্ষিণাত্য অভিযানে সফলতার জন্য ১৬১৭ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর তৃতীয় পুত্র খুররমকে  শাহজাহান উপাধি দেন। খুররম / শাহজাহান রাজ পরিবারের সদস্য হওয়ায় তিনি ৩০ হাজার জাট এবং ২০ হাজার সওয়ারের  এর মনসবদার ছিলেন। 





সিংহাসনে আরোহন:

সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের শেষ দিকে শাহজাদা শাহরিয়ার এবং শাহজাহানের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরোধ বাঁধে। এই সময়ে নুরজাহানের প্ররোচনায় শাহরিয়ার লাহোর থেকে নিজেকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সময় শাহজাহান দাক্ষিণাত্য ছিলেন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নুরজাহানের ভাই আসফ খান কৌশলে প্রথমে খসরুর পুত্র দাওয়ার বক্সকে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। আসফ খান শাহজাহানকে দাক্ষিণাত্য থেকে দ্রুত রাজধানীতে আসার জন্য দুত প্রেরণ করেন। আসফ খান নিজেই বিরাট  সৈন্যবাহিনী নিয়ে লাহোরে উপস্থিত হয়ে শাহরিয়ার কে পরাজিত ও বন্দী করে অন্ধ করে ফেলেন। এদিকে শাহজাহান দ্রুত রাজধানীতে ফিরে আসেন। ১৬২৮ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ’আবুল মোজাফফর শিহাব উদ্দিন মোহাম্মদ সাহিবে কিরানে সানি শাহজাহান বাদশা গাজী’ উপাধি ধারণ করে মুঘল সিংহাসন করেন।  দাওয়ার বক্স পালিয়ে গিয়ে ইরানে আশ্রয় নেন। বন্দী অবস্থায় শাহরিয়ার কে হত্যা করা হয়। 


আরও পড়ুন-

সম্রাট জাহাঙ্গীর এর রাজত্বকাল এবং তাঁর উপর নুরজাহানের প্রভাব



বিদ্রোহ দমন:

  1. বুন্দেলখন্ডে বিদ্রোহ দমন:

বুন্দেলখান্ডের রাজপুত  বুন্দেলা সিংহের পুত্র সর্দার জুঝর সিংহ শাহজাহানের রাজত্বের প্রথম বছরই বিদ্রোহ করেছিলেন। মহাব্বত খানের নেতৃত্বে জুঝর সিংহের বিদ্রোহ দমন করা হয়। কিন্তু ১৬৩৪ সালে জুঝর পুনরায় বিদ্রোহ করলে মুঘল সেনাবাহিনী তাকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে।  


  1. খানজাহান লোদীর বিদ্রোহ দমন:

খানজাহান লোদী দাক্ষিণাত্যের সুবেদার ছিলেন। আহমদনগর এর সর্বশেষ নিজাম শাহী সুলতান নিজামুল মুলুকের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে তিনি বিদ্রোহ করেন। কতিপয় মারাঠা নেতা এবং কিছু রাজপুত তাকে সাহায্য করে। তিন বছর যাবত খানজাহান লোদীর সাথে মুঘলদের লড়াই অব্যাহত থাকে। অবশেষে ১৬৩১ সালে মুঘল বাহিনীর হাতে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে খানজাহান লোদী নিশংসভাবে নিহত হন। 


  1. পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

সম্রাট শাহজাহান নানাবিধ কারণে প্রত্যেকে বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন যেমন-

  1. শুল্ক ফাঁকি দেয়া:

পর্তুগিজরা রাষ্ট্রের নির্ধারিত রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। 

  1. দাস ব্যবসা করা:

পর্তুগিজরা ভারতে  দাস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিবদেরকে অপহরণ করে তারা দাস হিসেবে জোরপূর্বক ইউরোপ আমেরিকায় বিক্রি করে দিত। 

  1. কৃষক ও দরিদ্রের উপর অত্যাচার:

প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র এবং কৃষকদের উপর নিপীড়ন করে তারা তাদের থেকে জোরপূর্বক উৎপাদিত পণ্য কম মূল্যে ক্রয় করে নিত। গ্রাম অঞ্চলে তারা লুটতরাজ করত। 

  1. বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ:

পর্তুগিজরা বলপূর্বক ভারতীয়দেরকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কাজে লিপ্ত হয়েছিল। 

  1. হুগলি বন্দরে অস্ত্রবাজী:

হুগলি বন্দরের ব্যবসা নিজে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তারা প্রায় অস্ত্রাবাজি করত। 

  1. মমতাজের দাসী অপহরণ

সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের দুইজন যুবতী ক্রীতদাসীকে হুগলির পর্তুগিজরা জোরপূর্বক  অপহরণ করে নিয়ে যায়। 

  1. শাহজাহানকে উপহার প্রেরণ না করা

সম্রাট শাহজাহান ক্ষমতায় আসলে বিদেশী বণিক হিসেবে তারা তাকে উপহার উপঢৌকন প্রেরণ করেনি এবং শুভেচ্ছা জানায়নি। 


পর্তুগিজদের এই সমস্ত অপরাধের কারণে সম্রাট অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে এই  অত্যাচারী পর্তুগীতের দমন করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। কাশিম খানের পুত্র এনায়েতুল্লাহ খান এর নেতৃত্বে এক বিরাট মুঘল বাহিনী ১৬৩২ সালে পর্তুগিজ বাণিজ্য কেন্দ্র হুগলি আক্রমণ করে এবং তিন মাসের অধিক কাল অবরোধ করে যুদ্ধে তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে। এই যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার পর্তুগিজ নিহত হয় এবং ৪,৪০০ বন্দী হয়। বন্দিদের অনেকেই কারারুদ্ধ অবস্থায় মারা যায়। অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুক্তি পায়। শেষ পর্যন্ত অবশিষ্টদের কে হুগলিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। 




আরও পড়ুন-




দুর্ভিক্ষ ও মহামারী:

সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে ১৬৩০-৩২ সালে দাক্ষিণাত্যে এবং গুজরাটে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। ইংরেজ পর্যটক পিটার মান্ডি, চার্লস টেম্পল, ঐতিহাসিক মির্জা আমীন কাজভিনী, আব্দুল হামিদ লাহোরীর এবং ইরফান হাবিবের বর্ণনায় এই দুর্ভিক্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। 


তাদের বর্ণনামতে- 

  1. গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে প্রচন্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। 

  2. রুটির জন্য মানুষ বিক্রি করা হতো কিন্তু ক্রেতা পাওয়া যেত না 

  3. মানুষ মৃত মানুষের মাংস খেতে শুরু করে 

  4. দোকানিরা ময়দার সাথে মৃত মানুষের হাড়ের গুরু মিশিয়ে দিত 

  5. ছাগলের মাংস হিসেবে কুকুরের মাংস বিক্রি হতো 

  6. এই দুর্ভিক্ষে আহমদনগরেই  প্রায় ১০ লাখ মানুষ মারা যায়

সম্রাট দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।


সম্রাট শাহজাহানের রাজ্য বিস্তার: 

  1. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নীতি:

১৬৩৮ সালে সম্রাট শাহজাহান ইতিপূর্বে হারিয়ে যাওয়া কান্দাহার অধিকার করতে সক্ষম হন। কিন্তু ১৬৪৯ সালে তা আবার হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৬৪৯, ১৬৫২,১৬৫৩ এই তিন বছর পর পর তিনটি অভিযান পরিচালনা করা হয় কিন্তু  এসব অভিযানে রাজকীয় বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে তিনটি অভিযানই ব্যর্থ হয়।  এতে সম্রাটের প্রায় ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। 


  1. মধ্য এশিয়ার নীতি 

১৬৪৬-৪৭ সালে মধ্য এশিয়ার বলখ ও বাদাখশান অভিযান করেন সম্রাট শাহজাহান। তৈমুরিয়া সাম্রাজ্যের এসব অঞ্চল দখল করা তার আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা এ নিয়ে সম্রাট বিবেচনা করেননি। মুঘল সম্রাটগন তৈমুরিয়  বংশোদ্ভত হওয়ায় পিতৃভূমি জয় করার একটি অংশ ছিল শাহজাহানের এই অভিযান। পুত্র মুরাদ ১৬৪৬ সালে বলখ ও বাদাখশান জয় করতে সক্ষম হন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তারা ফিরে আসেন। পরবর্তীতে সম্রাট পুত্র আওরঙ্গজেবকে বলখ ও বাদাখশান নিয়ন্ত্রণে প্রেরণ করেন।  কিন্তু দুর্ধর্ষ উজবেকদেরকে প্রতিরোধ করে আওরঙ্গজেব বলখ ও বাদাখশান ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে কাবুলে ফিরে আসেন। ফলে মুঘলদের বলখ ও বাদাখশান অভিযান ব্যর্থ হয়।  এই অভিযানে প্রায় ৫ হাজার সৈন্য নিহত হয় এবং প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। 


  1. দাক্ষিণাত্য নীতি:

সম্রাট শাহজাহান মুঘলদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী দক্ষিণ ভারতের সুলতানি রাজ্যগুলো দখল করার জন্য দাক্ষিণাত্য নীতি গ্রহণ করেন। একজন সুন্নি মুসলিম হয়ে সাম্রাজ্যের প্রান্ত সীমায় শিয়া রাজের শক্তিশালী অবস্থান তিনি সহ্য করতে পারেননি। তাই সম্রাট শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য নীতির উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়। সম্রাটের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আহমদ নগরের ত্রানকর্তা ও যোগ্য মন্ত্রী মালিক অম্বর এর মৃত্যু, দাক্ষিণাত্যে দুর্ভিক্ষ, আহমদনগর এর শাসক ফতেহ খানের বিশ্বাসঘাতকতা ও অকর্মণ্যতা প্রভৃতির কারণে সম্রাট শাহজাহান  দাক্ষিণাত্য অভিযানে উৎসাহী হন। সম্রাট শাহজাহানের দাক্ষিণাত্য অভিযানকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।  যেমন-


  1. আহমদনগর দখল:

আহমদ নগরের মন্ত্রী মালিক অম্বরের মৃত্যুর পর তাহার অযোগ্য ও অকর্মণ্য পুত্র খান ফতেহ খান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। সে বিশ্বাসঘাতকতা করে মুঘলদের সাথে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আহমদনগরের সুলতান নিজামুল মুলক কে হত্যা করে তার দশ বছরের নাবালক  পুত্রকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মহাব্বত খান আহমেদনগরের দৌলতাবাদ দুর্গটি আক্রমণ করলে ফতেহ খান বিরোধিতা শুরু করেন। অতঃপর ১০ লক্ষ ৫০ হাজার মুদ্রা ঘুষ গ্রহণ করে ফতেহ খান আহমদনগর কে মুঘলদের হাতে সর্মপন করেন। এভাবেই ১৬৩৩ সালে আহমদনগর মুঘলদের অধীনে চলে আসে এবং নিজাম শাহী সালতানাতের অবসান ঘটে। নাবালক সুলতান হুসেন শাহ কে আজীবন বন্দী হিসেবে গোয়ালিয়র দুর্গে রাখা হয়। 


  1. গোলকুন্ডা ও বিজাপুর অধিকার:

শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী ঐশ্বর্যশালী বিজাপুর ও গোলকুন্ডা রাজ্যের স্বাধীনতা সম্রাট শাহজাহানের কাছে ছিল অসহনীয়। তিনি রাজ্য দুটি দখলে বদ্ধপরিকর হন। ১৬৩৬ সালে সম্রাট এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বিজাপুর ও গোলকুন্ডা অভিযানে যাত্রা করেন। মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত ভেবে গোলকুন্ডার সুলতান বিনা বাধায়, বিনা যুদ্ধে সম্রাটের প্রভূত্ব মেনে নিয়ে করদানে স্বীকৃত হন। 


এদিকে বিজাপুরের সুলতান মোঘল প্রবর্তিত মেনে নিতে অস্বীকার করলে সম্রাটের বিশাল বাহিনী বিজাপুর আক্রমন করে। ১৬৩৬ সালে বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ আত্মসমর্পণ করে মুঘল বশ্যতা মেনে নেন এবং করদানে স্বীকৃত হন এবং মারাঠা নেতা  শাহজী ভোঁসলে এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। 


  1. আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার নিয়োগ:

১৬৩৬ সালে দাক্ষিণাত্য বিজয় সম্পন্ন করে সম্রাট শাহজাহান রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর তার তৃতীয় পুত্র ১৮ বছরের যুবক আওরঙ্গজেবকে মুঘল দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১৬৩৬ থেকে ১৬৪৪ এবং ১৬৫৩ সাল থেকে পরবর্তী সম্রাট হওয়া পর্যন্ত আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবেদার ছিলেন। দাক্ষিণাত্যের সুবেদার থাকাকালে আওরঙ্গজেব অত্যন্ত দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। 



আরও পড়ুন-






শিল্পকলা ও স্থাপত্যে শাহজাহানের অবদান

শিল্পকলা ও স্থাপত্যের শাহজাহানের বিশাল অবদানের জন্য তাকে বলা হয় স্থাপত্যের রাজপুত্র বা প্রিন্স অব বিল্ডার্স । তার যে সমস্ত স্থাপনা তাকে অমর করে রেখেছে সেগুলো হলো-


  1. তাজমহল:

সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি আগ্রার তাজমহল। এর স্থপতি ওস্তাদ ঈসা খাঁ। প্রিয়তম স্ত্রী মমতাজ মহলের আকস্মিক মৃত্যুতে মর্মাহত হয়ে তার স্মৃতির নিদর্শন স্বরূপ সম্রাট শাহজাহান আগ্রার তাজমহল নির্মাণ করেন। ১৬৩২ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৬৫৩ সালে তা সমাপ্ত হয়। দেশি এবং বিদেশি ২০ হাজার শিল্পি ও কারিগর ২২ বছর ধরে এটি নির্মাণ করেন। 


  1. নতুন দিল্লির প্রতিষ্ঠাতা:

সম্রাট শাহজাহান শাহজাহানাবাদ নামে এক নতুন শহরের গোড়াপত্তন করেন।  এখানে ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৮ থেকে ৪৯ সালের মধ্যে এই নতুন শহরটি নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে এটি নতুনদিল্লি নামে পরিচিত। 

 

  1. লালকেল্লা:

সম্রাট শাহজাহান দিল্লিতে লালকেল্লা নামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। শাহজাহান এবং তার পরিবার এই দুর্গে থাকতেন। ১৬৩৮ সালে মুঘলদের রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেন।  ১৬৩৮ থেকে ৪৮ সালের মধ্যে এর কাজ সম্পন্ন হয়।  এটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল দিওয়ান-ই-আম এবং দিওয়ান-ই খাস। 


  1. মোতি মসজিদ (1645-53)

লালকেল্লার দিওয়ান-ই-আম কমপ্লেক্স এর অভ্যন্তরে মোতি মসজিদ অবস্থিত। সম্পূর্ণ সাদা মরমর পাথরে নির্মিত এবং মুক্তার মত দ্যুতির কারণে এর নামকরণ করা হয় মোতি মসজিদ। ১৬৪৫ থেকে ৫৩ সালের মধ্যে এটি নির্মিত হয়। উল্লেখ্য যে একই নামে লাহোরের দুর্গে আরেকটি মোতি মসজিদ রয়েছে। কোন কোন বর্ণনা মতে লাহোরের দুর্গটি সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেছেন আর লালকেল্লার মোতি মসজিদটি নির্মাণ করেছেন আওরঙ্গজেব।


  1. দিল্লি জামে মসজিদ:

সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তির আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে দিল্লির জামে মসজিদ। ১৬৫০ সালে সম্রাট শাহজাহান এটি নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৬৫৬ সালের শেষ হয়। এটি লাল বালু ও পাথর দ্বারা নির্মিত। অসাধারন নির্মাণ শৈলির কারণে এটি আজও ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দর্শনীয় স্থান। 

 

  1. ময়ূর সিংহাসন:

শাহজাহানের আরেকটি অমর কীর্তি হচ্ছে ময়ূর সিংহাসন। এটা ছিল তার সৌন্দর্যজ্ঞান ও ঐশ্বর্যের উজ্জ্বলতম নিদর্শন। সিংহাসনে আরোহন করার পরেই তিনি এই ময়ূর সিংহাসন নির্মাণের আদেশ দেন। সাত বছরের পরিশ্রমে ৮ কোটি মুদ্রা ব্যয়ে মনিমুক্তা খচিত এই সিংহাসনটি নির্মাণ করা হয়। ময়ূর সিংহাসনের চারটি পায়া ছিল স্বর্ণ নির্মিত।  পারস্য সম্রাট নাদির শাহ ভারত আক্রমনকালে  এটি পারস্যে নিয়ে যান। 


আরও পড়ুন-




সম্রাট শাহজাহানের চরিত্র:

বার্নিয়ার, মানুচি ও ভিনসেন্ট স্মিথসহ অনেক ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক তার চরিত্রের কঠোর সমালোচনা করে তাকে নীতি জ্ঞানহীন, নিষ্ঠুর, বিশ্বাসঘাতক, ইন্দ্রিয় আসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা সর্বৈব সত্য নয়। ভারতীয় ঐতিহাসিকরা তার ভূয়োষী প্রশংসা করেছেন। সিংহাসন লাভের জন্য ভাতৃ হত্যা এটি ছিল ঐ যুগের একটি স্বাভাবিক ঘটনা। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং তার অবাধ্যতার জন্য তিনি যতটুকু দায়ী ছিলেন তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল নুরজাহানের চক্রান্ত। আর পর্তুগিজ্যের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান গ্রহণের যথেষ্ট কারণ ছিল। তাঁর দরবারে তখনও জেসুইট ধর্মযাজকগণ বেশ সম্মান লাভ করতেন। 


সম্রাট শাহজাহানের কৃতিত্ব

  1. বিজেতা:

বিজেতা হিসেবে সম্রাট শাহজাহানের কৃতিত্ব রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তনীতি এবং মধ্য এশিয়া নীতিতে তিনি ব্যর্থ হলেও দাক্ষিণাত্য নীতিতে তিনি দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন। তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে দাক্ষিণাত্যের আহমদনগর বিজাপুর এবং গুলকুন্ডা রাজ্যগুলো অধিকার করতে সক্ষম হন।  


  1. প্রতিভাবান ও প্রজাবৎসল শাসক:

সম্রাট শাহজাহান একজন প্রতিভাবান এবং প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ সম্রাট শাহজাহানের প্রজাবাৎসল্য,সুষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা, নিরপেক্ষ বিচার ও দেশের সুখ সমৃদ্ধির প্রশংসা করেছেন। 


  1. শিক্ষা ও সংস্কৃতিমনা:

ফার্সী ও হিন্দি ভাষায় সম্রাট শাহজাহানের যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি ছিল। সাহিত্যের প্রতি তার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষা, সাহিত্য ও কাব্যের যথেষ্ঠ উন্নতি ঘটেছিল। এ সময় আব্দুল হামিদ লাহোরী ‘বাদশানামা’ এবং কাফি খান ‘মুনতাখাব উল-লুবাব’ রচনা করেন।  

 

  1. স্থাপত্যের রাজপুত্র:

স্থাপত্য শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য সম্রাট শাহজাহানকে বলা হয় স্থাপত্যের রাজপুত্র। শিল্প ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ভারতের ইতিহাসে তিনি অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর সময়ে নির্মিত তাজমহল, লালকেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ, মোতি মসজিদ, দিওয়ান ই আম, দিওয়ান-ই খাস, খাসমহল, শীষ মহল, ময়ূর সিংহাসন তার উন্নত রুচিবোধের পরিচয় বহন করে। 


  1. স্বর্ণযুগের স্রষ্টা:

সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলে প্রসিদ্ধ। সম্রাট শাহজাহান যেমন ছিলেন সর্বাধিক জাঁকজমকীয় সম্রাট তেমনি তাঁর সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য  গৌরব ও সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে পৌছেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি তাঁর আমলে চরমে পৌছেছিল। 



সমালোচনা:

সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে মোগল সাম্রাজ্য গৌরব এবং সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখর আরোহণ করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সম্রাটের মুকুটে বিশ্ববিশ্রুত কোহ-ই-নুর মণি, মণিমুক্তা খচিত ময়ূর সিংহাসন, তাজমহল প্রভৃতি মর্মর সৌধ সম্রাটের ধনসম্পদ, আড়ম্ভর- ঐশ্বর্যের নিদর্শন এ বিষয়েও সন্দেহ নাই। কিন্তু এগুলো তার আমলের জনসাধারণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে না।  তাঁর আড়ম্বরপূর্ণ বাহ্যিক রূপের মধ্যে ছিল এক ক্ষয়িঞ্চু অভ্যন্তর। জনসাধারণের উৎপাদিত সম্পদ সম্রাটের আড়ম্বরপূর্ন ও বিলাস প্রিয় জীবন কাটাতে ব্যয় করা হয়েছিল। সেই সাথে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বার্থলোলুপতা ও অত্যাচার জনসাধারণের বিশেষভাবে কৃষক ও শিল্প-শ্রমিকদের উপর চরম দুর্দশার সৃষ্টি করেছিল। সাম্রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ, বিশাল সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন, ব্যয়বহুল সৌধ নির্মাণের ব্যয় জনসাধারণের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ বাড়িয়েছিল।  এ রকম ব্যয় বাহুল্যের কারণে ক্রমে ক্রমে জাতীয় দেউলিয়াত্ব শুরু হয়েছিল। 



আরও পড়ুন-

ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান


আরও পড়ুন-

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ।। ‍Shah Wali Ullah 


আরও পড়ুন-

নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত







সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি:

  1. এ কে এম আব্দুল আলীম, ভারতের মুসলিম রাজত্বের ইতিহাস ,মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, নবম মুদ্রণ, 2015







No comments:

Post a Comment