Breaking

Monday 19 September 2022

মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল

                                           মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত (622):

কারণ ও ফলাফল

Hizrat of Muhammad (SM) (622):

Causes and Effects


পৃথিবীতে প্রেরিত সকল নবী রাসুলই তাওহীদের বানী প্রচারের জন্য স্বীয় জন্মভূমি ত্যাগ করেছেন। মুহাম্মদ সঃ এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। হিজরত মুহাম্মদ সঃ এর জীবন ও মিশনের মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে। মানবতার ধর্ম ইসলামের একমাত্র মহাপুরুষ হজরত মুহাম্মদ (স.) এর ওপর যখন আল্লাহর সুমহান বাণী পবিত্র কুরআন নাজিল হয়, তখন থেকে তিনি কুরআনের অসীম মর্যাদা মানবজাতির কাছে পৌঁছে দিতে সর্বোচ্চ কাজ করতে থাকেন। নবুয়তপ্রাপ্তির পর রাসূল সা: তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। তারপর আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেন। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। অবিশ্বাসীদের কাছে প্রকাশ্য শত্রু বনে যান রাসূল (স.)। তারা বিভিন্নভাবে রাসূলের ক্ষতি করার চেষ্টা করে।নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে মাক্কায় ১৩ বছর ইসলামের দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:। পরে মহানবী সা: আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল মদিনার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান তিনি।এর মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে এক নতূন অধ্যায়ের সচনা হয়।





হিজরতের পরিচয়ঃ

'হিজরত' শব্দটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দেশত্যাগ, ছেড়ে দেয়া, বর্জন করা, ফেলে আসা ও স্থানান্তরিত হওয়া। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্য কোন দেশে যাওয়াকে হিজর বলে।

আল্লাহ তায়লার নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স) এর মক্কা থেকে ইয়াসরিব বা মদিনায় গমনকে হিজরত বলে। মক্কার কাফিররা দারুল নাদওয়া নামক বৈঠকে রাসূল (স) কে হত্যার দিনক্ষণ ঠিক করলে রাসূল (স) ওহীর তাদের এ ষড়যন্ত্র জানতে পারেন। হযরত মুহাম্মদ (স.) হযরত আবু বকর (রা) এর গৃহে গমন করেন এবং তাকে অবগত করান। ' দারুল নাদওয়া' বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতে কুরাইশরা হযরত মুহাম্মদ (স)  এর গৃহ ঘিরে রাখে। সে রাতেই হযর‍ত আলী (রা) কে নিজ বিছানায় শুইয়ে রেখে মহানবী (স) হযরত আবুবকর (রা) কে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং আলী (রা) কে গচ্ছিত আমানত ফেরত দানের নির্দেশ দেন। তিনি  ৬২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মক্কা হতে ২৫০ মাইল দূরে মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।


হিজরতের কারণসমূহঃ

হিজরতের কারণসমূহকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ এই দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।

ক. পরোক্ষ কারণসমূহঃ

খ. প্রত্যক্ষ কারণঃ

ক. পরোক্ষ কারণসমূহঃ

  1. হক বাতিলের দ্বন্দ্ব:

সত্য মিথ্যার লড়াই চিরন্তন। এ লড়াই অনন্তকাল ধরে  ছিল, আছে এবং  ভবিষ্যতেও থাকবে। রাত-দিন যেমন সহজেই অনুমান করা যায় তেমনি হক ও বাতিলও সবার কাছে স্পষ্ট। সত্য কোন দিন অসত্য কে সহ্য করতে পারে না। তাই কুরাইশরা সত্য ধর্ম ইসলামকে সহ্য করতে পারছিল না এমনকি রাসুল কেও মেনে নিতে পারছিল না। তাই বাধ্য হয়ে মুহাম্মদ (স.) হক বাতিলের এ লড়াইয়ে সত্য কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।


  1. ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা:

নবী-রাসূলগণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, সকল নবী রাসূলগণই তাওহীদের দাওয়াতের কারণে মাতৃভূমি এবং তার বাসিন্দাদের কাছে মর্যাদা পাননি। ধর্মের বাণী প্রচারের নিমিত্তে প্রায় সকল নবী রাসূলগণ নিজ এলাকা থেকে অন্যত্র হিজরত করেছিলেন। আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তিনি হিজরত করতে বাধ্য হয়েছেন।  


  1. স্বার্থবাদী সংঘাত:

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচারিত ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা তৎকালীন কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে চরম আঘাত হানে। আর কোন ব্যক্তি যখন কারো স্বার্থে আঘাত হানে তখন তারা ন্যায়-অন্যায় বিচার না করেই এর বিরোধিতা শুরু করে। রাসুলের বানী ও নীতি আদর্শ মক্কার অভিযাতদের স্বার্থে আঘাত হেনেছিল। তাই তারা তাদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে রাসুলের বিরোধিতা করে এবং তাকে হত্যার পরিকল্পনা দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। 


  1. পৌরহিত্যের লড়াই:

কুরাইশ পুরোহিতরা অভিজাত শ্রেণীর ইসলাম প্রচারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এযাবত তারা কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ ও মক্কার শাসনকার্য পরিচালনা করত। সেখানে তাদের পৌরোহিত্য কায়েম ছিল। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব পাশাপাশি ধর্মীয় কর্তৃত্ব তাদের হাতেই ছিল। কিন্তু মুহাম্মদ (স.) আনিত ইসলামের ধর্ম তাদের সেই পৌরহিত্যের আঘাত হানে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়িত হলে তাদের পৌরহিত্যের অবসান ঘটবে। তাই তারা তাদের  ধর্মীয় কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রাসূলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। 

 

  1. ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত:

মক্কাবাসীরা অধিকাংশই ছিল পৌত্তলিক তথা মূর্তিপূজারী। লাত, মানাত, হজ, হুবল, উজ্জাসহ তাদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল 360 টি মূর্তির প্রতি। এগুলা ছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূল ভিত্তি। ইসলঅম প্রচারের কারণে তাদের এতকালের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে। মূলত ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণেই তারা রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করতে শুরু করে। শুরু হয় নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র যার ফল হল হিজরত।


  1. মক্কার বিরুপ পরিবেশ:

নবুয়ত প্রাপ্তি এবং প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পর মক্কায় যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা কোন মতেই মোহাম্মদ (স.) এবং মুসলিমদের অনুকূলে ছিল না। সেখানে ছিল শুধু  শত্রু আর শত্রু। মক্কার অধিবাসীরা ছিল রুক্ষ ও উগ্র মেজাজের। ইসলাম বুঝার মতো কোনো ইচ্ছা ও মনমানসিকতা তাদের  ছিল না। রাসুলকে পরামর্শ ও সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া। এজন্যই তিনি হিজরত করার মনস্থ করেন।   




আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন


                                                                                

  1. অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি: 

মক্কায় ইসলাম গ্রহণ করা অর্থ ছিল কোরাইশদের অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে প্রস্তুত থাকা। মোহাম্মদ (স.) ও তার সাহাবীদের উপর কুরাইশরা তাদের অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি করেছিল এবং আবু তালিবের ইন্তিকালের পর সেটা সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করে। ফলে মোহাম্মদ (স.) তাঁর সাহাবীদেরকে গোপনে হিজরত করার নির্দেশ দেন এবং নিজেও মানসিকভাবে হিজরতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করেন। 


  1. মদিনার অনুকুল পরিবেশ

মদিনা ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাফেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।আবহাওয়া এবং ভৌগোলিক পরিবেশ ছিল মনোরম। সেখানকার অধিবাসীরা ছিল নম্র-ভদ্র এবং সহজেই প্রভাবিত হয় এমন চরিত্রের অধিকারী। তাছাড়া হযরত মুহাম্মদ (স.) এর সাথে মদিনার লোকদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তারাও মুহাম্মদ (স.) এবং ইসলামকে নিজেদের মধ্যে পেতে চেয়েছিল। সবমিলিয়ে মদিনার পরিবেশ ছিল ইসলাম প্রচার ও রাসুলের জন্য সম্পূর্ণ অনুকূলে। তাই তিনি হিজরত করার জন্য মনস্থির করেন


  1. মদিনায় ইয়াহুদি-খ্রিস্টানদের ব্যর্থতা:

তৎকালীন আরবের ইহুদী-খৃষ্টানরা তাদের ধর্মের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল। মদিনার ইয়াহুদী এবং খ্রিস্টানরা তাদের আদর্শ ও বিকৃত ধর্ম দ্বারা মদীনাবাসীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। মদিনাবাসীরাও তাদের একজন আদর্শ নেতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। মক্কাতে প্রচারিত রাসুলের আদর্শ সহজেই তাদের কে প্রভাবিত করেছে। সেজন্য মুহাম্মদ (স.) ইসলামের সুদৃঢ় ভিত্তি রচনা করতে মদিনায় যেতে চাইলেন। 


  1. মদিনার সাথে আত্মীয়তার সর্ম্পক:

মদিনা ছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু সালামের মাতুলালয় নবীজির পিতা আব্দুল্লাহ এবং পুরুষ মদিনাতে বিবাহ করেছিলেন মদিনায় গেলে আত্মীয়দের সহযোগিতা পাবেন এমন ধারণা ছিল না ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তারপর আমাদের সাহায্য সহযোগিতা পাবেন এবং তাদের পেছনে ছিল তিনি সে সহযোগিতা পেয়েছিলেন


  1. কৌশলগত কারণ:

হিজরত ছিল মোহাম্মদ সঃ এর একটি কৌশলগত পরিকল্পনা। কৌশলগত কারণে প্রথমে কিছু ছাড় দিতে হয়। ঐ পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ  (সঃ) এর প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক শক্তি। আর শক্তি সঞ্চয় করার উপযুক্ত স্থান ছিল মদিনা। সে জন্য কাফেরদেরকে সাময়িকভাবে ছাড় দিয়ে পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। 

 


  1. অর্থনৈতিক কারণ

কুরাইশরা কাবাঘর রক্ষণাবেক্ষণ করত। প্রতি বছর হজ্ব পালন এবং হজ্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তারা প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হতো। আর বাইরে কাবাঘর রক্ষক হিসেবে তাদের সম্মান করা হতো। যদি মুহাম্মদ  (সঃ) এর প্রচারিত ধর্ম প্রতিষ্ঠা পায় তাহলে তো তা আর তাদের হাতে থাকবে না। তারা অর্থনৈতিক ভাবে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ফলে তারা বিরোধিতা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ সঃ কে মক্কা ছাড়তে বাধ্য করে।  


আরও পড়ুন-

খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা 

 


খ. প্রত্যক্ষ কারণঃ


  1. মদিনাবাসীদের আমন্ত্রন:

মোহাম্মদ সালাহ সালামের আদর্শ ও মহত্বের কথা তার নবুয়াত প্রাপ্তি তথা ইসলামের আগমনের পূর্বেই মক্কায় ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিবছর হজের মৌসুমে হাজীদের মাধ্যমে তার সুনাম বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। মদিনাবাসীগণ হজ্ব করতে এসে মুহাম্মদ সঃ এর আদর্শ এবং তার ধর্ম প্রচারের বিষয়ে জানতে পারে। তার মহত্ব তাদের হৃদয় জয় করেছিল। তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মদিনাবাসী মুহাম্মদ সঃ কে মদিনাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।  আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে হিজরত করেছিলেন। 


  1. আকাবার শপথ:

হজের মৌসুমে আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথে মক্কায় প্রায় 80 জন ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা নবীজির মহত্বে মুগ্ধ হয়ে অভিযোগে মদিনায় হিজরত করার পরামর্শ দেয় এবং তাকে নিরাপত্তাসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করে এবং ইসলামের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান পালনের ব্যাপারে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় মদীনাবাসীদের মনেপ্রাণে ইসলাম গ্রহণ এবং তাদের  আন্তরিক আমন্ত্রণকে রাসুল সঃ গ্রহণ করেছিলেন। 




  1. মদিনায় সরকারের অভাব:

তখনও মদীনা কেন্দ্রিক কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। মদিনার আউস ও খাজরাজ নামে দুটি গোত্র বসবাস করত। অনেক দিন থেকেই তাদের মধ্যে শত্রুতা চলে আসছিল। পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ তারা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়েছিল। এ সময় তারা নবীজির আদর্শ, নীতি এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারের কথা জানতে পারে। তাই তারা তাকে তাদের মধ্যকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মধ্যস্থতাকারী তথা একজন নেতা হিসেবে পেতে চেয়েছিল। 




আরও পড়ুন- খলিফা আব্দুল মালিক



  1. মুসআবের অনুকূল রিপোর্ট:

আকাবার শপথ এর সময়ে মদিনাবাসীর আমন্ত্রণ পেয়ে মোহাম্মদ সাঃ মদীনার পরিবেশ পরিস্থিতি সার্বিকভাবে অবলোকন করা এবং মদীনার মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেওয়ার জন্য মদিনায় প্রেরণ করেছিলেন। সেখানে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর মদিনার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুকূল রিপোর্ট প্রদান করলে নবী মদিনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন। 


  1. মদিনার ভৌগলিক গুরুত্ব:

তৎকালীন মদিনা ব্যবসাক্ষেত্রে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। আরবের মধ্যে মদিনার সাথেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কাফেলার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বসবাস ছিল সেখানে। ইয়েমেন থেকে সিরিয়া এবং সিরিয়া থেকে ইয়েমেনে বানিজ্যিক কাফেলাগুলো মদিনার পথ ধরে আসা-যাওয়ার করত। এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে তা ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে মোহাম্মদ সালাহ সালাম এটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি মদিনায় হিজরত করেছেন।



  1. রাসুল (স.) কে হত্যার ষড়যন্ত্র:

ইসলাম এবং মোহাম্মদ সাল্লাহ সালামকে স্তব্ধ করার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কুরাইশরা দারুন নদওয়ার বৈঠকে বসে এক ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা রাতের আধারে প্রতি গোত্রের একজন করে যুবক মোহাম্মদ সালাহ সালামের বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ছিল মূলত আবু জাহলের সিদ্ধান্ত।

 

আবু জাহাল বলেছিলেন- 

আমাদের প্রত্যেক গোত্র থেকে এক একজন শক্তিশালী সম্ভ্রান্ত যুবক বাছাই করতে হবে তারপর তাদের প্রত্যেককে আমরা একটা করে ধারালো তরবারি দেবো। ওই যুবকরা একযোগে হামলা চালিয়ে মোহাম্মদ কে হত্যা করবে [সীরাতে ইবনে হিশাম]


এই সিদ্ধান্ত জানার পর মোহাম্মদ সঃ এর পক্ষে মদিনায় থাকার আর কোন সুযোগ ছিল না। 


  1. আল্লাহর নির্দেশ:

উপরে উল্লেখিত অবস্থার প্রেক্ষিতে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানসিকভাবে মদিনায় হিজরত করতে তৈরি ছিলেন। কিন্তু তখনও আল্লাহর নির্দেশ আসেনি।সংকট যখন চরম মুহুর্তে প্রশ্ন আল্লাহ তাআলা জিব্রাইল এর মাধ্যমে হিজরতের হিজরতের নির্দেশ পাঠালেন আল্লাহর আদেশ পাওয়ার পর ইসলাম প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে 622 সালে  মুহাম্মদ (সঃ)  মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। 



আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ


হিজরতের ফলাফল/গুরুত


হিজরতের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। মূলত এ কারণেই মুহাম্মদ (স.) এর জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়। নিপীড়িত, অত্যাচারিত এক পরিবেশ থেকে তিনি মদিনায় গিয়ে এক মহাসম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত হন। এখান থেকেই শুরু হয় ইসলামের অগ্রাভিযান। হিজরতের গুরুত্ব ও ফলাফল আলোচনা করা হলো-

  1. নবযুগের সূচনা:

হিজরতের মাধ্যমেই মক্কার কষ্টকর জীবনের অবসান ঘটে এবং ইসলামের নতুন জীবনের সূচনা হয়। এবার শুরু হয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার অধ্যায়। মদিনাকে মুসলমানরা একটি নিরাপদ আবাসস্থল এবং শক্তি হিসেবে খুঁজে পায়।



  1. নির্যাতনের অবসান:

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের জন্য মক্কার জীবন ছিল এক দুর্বিষহ অধ্যায়। হিজরতের মাধ্যমে মক্কার এই দুর্বিসহ জীবনের অবসান ঘটে। শুধু তাই নয় বিপরীতে মুসলিমরা মদিনায় এসে এক সম্মানিত আসনে সমাসীন হয় এবং নিরাপত্তা লাভ করে। মদীনায় কোন মুসলিমকে আর নিপিড়নের ভয়ে ভীত  থাকতে হয়না। এখন শুধু একটাই কাজ, ইসলামের প্রচার এবং প্রসার। 


  1. মদিনার নামকরণ:

মদীনার পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব, মদীনাবাসী জীবনে ইসলাম এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে হিজরতের সাথে সাথে ইয়াসরিবের নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো ‘মদীনাতুন্নবী’ বা নবীর শহর। সেই থেকে অদ্যাবধি ইয়াসরিব মদিনা নামেই অধিক পরিচিত এবং এক পবিত্র শহর বলে বিবেচিত।


  1. ইসলামি রাষ্ট্র গঠন:

হিজরতের পর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। পরিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যে রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োজন ছিল সেই রাষ্ট্র তিনি হাতে পেয়ে যান। তিনি মদিনায় বসবাসরত ইহুদী-খৃষ্টান, পৌত্তলিক, মুসলমান, আনসার, মুহাজির সবার সমন্বয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন যা ছিল ‘মদিনা প্রজাতন্ত্র’।


  1. মদিনার সনদ প্রনয়ণ:

কোন জাতি বা গোষ্ঠীকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজন ছিল কিছু আইন-কানুন বা সংবিধানের। মুহাম্মদ (স.) প্রত্যেক সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করে হিজরতের পর পরই 47/53/57 ধারা বিশিষ্ট একটি সনদ প্রণয়ন করেন যা ইতিহাসে ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান 




  1. গোত্রীয় বিবাদরে অবসান:

মদিনায় যুদ্ধ-সংঘাত ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিশেষ করে আউস ও খাজরাজ এই দুই গোত্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের চলে আসা বিবাদ সংঘাত ভয়ানক পরিস্থিতির ধারণ করেছিল। নবীজির আদর্শ আর ধর্মীয় বিধানের আলোকে তাদের মাঝে এক নতুন ভাবের জন্ম হয়। মুহাম্মদ (স.)  তাদের শত্রুতা দূরীভূত করতে সক্ষম হন এবং ভ্রাতৃত্বের সৌধ নির্মাণ করেন। তখন থেকেই সবাই হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ভাই হয়ে জীবন যাপন শুরু করেছিল। মদিনার এই সমাজ ছিল গোত্রীয় রেষারেষি মুক্ত এক আদর্শ সমাজ।  





আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে ভূ প্রকৃতির প্রভাব



  1. মসজিদে নববি প্রতিষ্ঠা:

মুহাম্মদ (স.) মদীনার আবু আইয়ুব আনসারীর বাড়িতে প্রথমে অবস্থান করেন তাঁর উট প্রথমে যে স্থানে বসে ছিল তিনি সেই স্থানটিতে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। নবীজির সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সাহাবীদের উৎফুল্ল সহযোগিতায় মদিনায় প্রতিষ্ঠা হলো প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে নববী’। মসজিদে নববী ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। মদিনা রাষ্ট্রের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল মদিনা মসজিদ ।


  1. জাতি ও জাতিয়তাবাদের গোড়াপত্তন:

হিজরতের ফলে ইসলামের আদর্শের আলোকে মুসলিম জাতিসত্তা গঠনের সুবর্ণ সুযোগ আসে। প্রথমে সকল মদীনাবাসী কে নিয়ে মদীনার সনদ প্রণয়ন করা হয়, অতঃপর সনদ ভঙ্গ করে যারা কুরাইশদেরকে সাহায্য করেছিল তাদেরকে শাস্তি এবং মদীনা থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। মদিনায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি তাঁর দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে সকল মুসলমানদের একত্রিত করে বিশ্বের বুকে নতুন জাতি হিসেবে মুসলিমদের পরিচিত করে তোলেন।  খলিফা ওমরের সময়ে এ মুসলিম জাতিসত্তা আরো বেশি সুসংহত হয়।


  1. ইসলাম প্রচারের অবারিত সুযোগ:

হিজরত মানেই ছিল ইসলামের বিজয়। মক্কাতে ইসলাম ছিল কুরাইশদের করুনার বিষয়।  হিজরতের মাধ্যমে সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এখানে কোন বাধা তো ছিলই না বরং সবাই ছিল ইসলামের প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ। এই সুযোগে গোটা বিশ্বে ইসলামের বাণী প্রচারের পথ প্রশস্ত হয়। ফলে আরবের মানুষের দ্বারে দ্বারে ইসলামের বাণী পৌঁছে যায়। মানুষ ইসলামকে  বোঝার সুযোগ পায়। 


  1. বিশ্ববিজয়ে ইসলাম:

মক্কাতে ইসলাম নিজের শক্তিকেই প্রকাশিত করতে পারেনি। সেখানকার পথ ছিল বিপদসংকুল, কিন্তু হিজরত করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসলে অবস্থা হয় বিপরীত। মক্কা চেয়ে মদিনার আন্তর্জাতিক গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বানিজ্য কাফেলা মদিনার পথ ধরেই আসা-যাওয়া করত। এই পরিস্থিতে মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলো এবং আরবের গণ্ডি পেরিয়ে তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এখান থেকে বিশ্ব বিজয়ের সূচনা হয়। একসময় অর্থ জাহান ব্যাপী  ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। 


  1. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি: 

এতোকাল মদিনার সকল গোত্র ছিল পরস্পর পৃথক এবং বিরূপ ভাবাপন্ন মদিনার আনসার এবং মক্কার মুহাজিরদের মধ্যে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাচীর সম ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি করলেন। তাদের দৃঢ় মনোবল এবং রাসূলের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্য সকল পরাশক্তির মনে ভীতির সঞ্চার করেছিল। এ ঐক্যকে কাজে লাগিয়েই মুহাম্মদ (সঃ) ইসলামের বিজয় গাথা রচনা করেছিলেন।  


  1. রাসল (স.) এর রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের বহি:প্রকাশ:

নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে তিনি ছিলেন আল-আমিন (বিশ্বস্ত)। নবুয়ত প্রাপ্তির পর মক্কার কাফিররা সেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্বোধ, পাগল ইত্যাদি বলে অপপ্রচার চারিয়েছিল। কিন্তু হিজরতের পর মোহাম্মদ (সাঃ) মদিনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভ করেন এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। মদিনার সনদ প্রণয়ন, ইসলামী রাষ্ট্র গঠন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড দ্বারা তিনি যে শুধু একজন ধর্ম প্রধানই নন বরং বিশ্ব বিখ্যাত দূরদর্শী একজন রাজনীতিবিদ তারই প্রমাণ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরলেন। 


হিজরত ইসলাম এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। হিজরত ইসলামের বিজয়ের ভিত্তি রচনা করেছে। হিজরতের পর ইসলাম মানব জীবনের একটি জীবনের একটি ধর্ম এবং পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। মোহাম্মদ (সাঃ) যে ধর্ম গুরুর পাশাপাশি একজন বিশ্ব বিখ্যাত নেতা, রাজনীতিবিদ এবং সেনাপতি ছিলেন তার প্রমাণ বিশ্ববাসী অবলোকন করেছে।  মক্কাতে 13 বছরে তিনি যা করতে পারেননি মদিনাতে মাত্র 10 বছর তা করেছেন। তিনি আবরদের জীবনে ইসলামের মাধ্যমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলামের সুমহান আদর্শ।  





আরও পড়ুন-

বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি,  Ethnographic identity of the Bengali nation







Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.






No comments:

Post a Comment