Breaking

Saturday 23 July 2022

বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি, Ethnographic identity of the Bengali nation

বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি  

নৃগোষ্ঠীর পরিচয়ঃ

নৃগোষ্ঠী: ‘নৃ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানুষ। শব্দটি বাংলা ভাষায় উপসর্গ হিসেবে ব্যবহূত হয়। নৃগোষ্ঠী অর্থ মানবগোষ্ঠী। নৃগোষ্ঠী বলতে কোনও সমাজে বিদ্যমান বিপুল সংখ্যক মানুষের একটি দলকে বোঝায় যার সদস্যরা সামাজিক বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পরস্পর একাত্মতা প্রকাশ করে এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে নিজেদেরকে পৃথক ও স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে।

নৃগোষ্ঠী বলতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কতকগুলো সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট মানবপ্রজাতির উপবিভাগকে বুঝায়। এক্ষেত্রে বিবেচ্য দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো মাথার চুল, মাথার আকৃতি, নাকের ধরন, চোখের গঠন ও চোখের মণির রঙ, মুখমন্ডলের গঠন, ঠোঁটের প্রকৃতি, গায়ের রঙ, দৈহিক উচ্চতা ইত্যাদি। এছাড়া কখনও কখনও চোখের ভ্রু, কানের প্রকৃতি, কপালের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিষয়গুলোও বিবেচিত হয়ে থাকে।






নৃবিজ্ঞানী E.B Tylor এর মতে-

নৃগোষ্ঠী হল মানবজাতির একটি প্রধান বিভাগ যার রয়েছে উত্তরাধীকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় এমন কিছু নির্দিষ্ট দৈহিক বৈশিষ্ট্যাবলী, সাধারণ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীকেও তিনি নৃগোষ্ঠী বলে অভিহিত করেছেন

সমাজবিজ্ঞানী John M. Shepard তাঁর ‍Sociology গ্রন্থে বলেন-

নৃগোষ্ঠী হচ্ছে জনসংখ্যার সেই এক বিশেষ অংশ যারা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কতগুলো দৃষ্টিগোচর দৈহিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

নৃবিজ্ঞানী মেয়ার এর মতে,

নরগোষ্ঠী হল একটি সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী এমন একদল মানুষ যাদের মধ্যে সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং যারা অন্যদের থেকে দৈহিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভিন্ন।

সুতরাং নরগোষ্ঠী হচ্ছে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অভিন্ন দৈহিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানবগোষ্ঠী, যারা বিশ্বের নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে অভিন্ন সংস্কৃতির অনুসারী হয়ে বসবাস করে।বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সদস্যরা সাধারণত তাদের সাংস্কৃতিক এবং শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ভিন্ন হয়।

 

নরগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য:

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে নরগোষ্ঠীর কতিপয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন:

(ক) নরগোষ্ঠী হচ্ছে মানবজাতির অন্যতম প্রধান উপবিভাগ;

(খ) নরগোষ্ঠীর মূলেত রয়েছে স্বতন্ত্র ও সাধারণ কিছুদৈহিক বৈশিষ্ট্য, যা সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়;

(গ) সাধারণত মাথার গড়ন, মুখের চোয়াল, চুলের রং ও ধরন, গায়ের রং, নাক, চোখ, শারীরিক গঠন ও উচ্চতার মাধ্যমে নরগোষ্ঠী নির্ধারিত হয়;

(ঘ) বংশগতভাবে প্রাপ্ত শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেই নরগোষ্ঠীকে পৃথক করা হয়;

(ঙ) নরগোষ্ঠী হচ্ছে মানবজাতির এমন এক ধরনের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য যা বংশ পরম্পরায় অব্যাহত থাকে;

(চ) নির্দিষ্ট নরগোষ্ঠী প্রায়শ একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমন্ডলে বসবাস করে;

(ছ) প্রত্যেক নরগোষ্ঠীর নিজস্ব স্বতন্ত্র সংস্কৃতি রয়েছে।

 

মানবজাতির নৃতাত্ত্বিক শ্রেণী বিভাগ

নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমগ্র মানবজাতিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়-

  1. ককেশয়েড/শ্বেতকায়

  2. নিগ্রোয়েড/কৃষ্ণকায়

  3. মঙ্গোলয়েড/বাদামী বা মঙ্গোলীয়

  4. অষ্ট্রালয়েড বা আদি অস্ট্রেলিয়

 

             বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ঃ

বাঙালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্ণয় করা সহজ নয়। বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বাহ্যিক দৈহিক আকৃতি ও বৈশিষ্ট পর্জযালোচনায় কোন বিশুদ্ধ নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়না। ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মতে বাঙ্গালিরা হচ্ছে সংকর জাতিগোষ্ঠী। বিভিন্ন ধারার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আজকের বাঙ্গালি জাতি। মিশ্রতা সত্ত্বেও বাঙালি জাতিকে অনেকে ‘অস্ট্রোএশিয়াটিক বা অস্ট্রিক’ বৈশিষ্ট্যের  অধিকারী বলেও অভিহিত করেছেন। কেবল দৈহিক বৈশিষ্ট্যেই নয়, বাঙালি সংস্কৃতি বিনির্মাণেও অস্ট্রিক তথা আদি-অস্ট্রেলীয়দের প্রভাব সর্বাধিক। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে সকল নৃতাত্ত্বি রক্তের ধারা এসে মিশেছে সেগুলো হলো-

ক) আর্য নরগোষ্ঠী (Aryan):

আর্যরা এদেশে বহিরাগত জনগোষ্ঠী তারা বাংলায় আগমন করে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগে। উত্তর ভারতের গিরিপথ দিয়ে এরা ভারতে প্রবেশ করে এবং ক্রমে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে বৈদিক সভ্যতার ধারক বাহক হচ্ছে আর্যরা। 

আর্যরা দুটি নরগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল যথা :

  1. আলপাইন (Alpine)জনগোষ্ঠী: 

এদের মূল জনস্রোত পামির মালভূমি থেকে এসেছে। বাংলার আলপাইন আর্যজনগোষ্ঠী ইন্দো-ইরানীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এরা এশিয়া মাইনর হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে এ দেশে প্রবেশ করেছে।

  1. নর্ডিক (Nordic) জনগোষ্ঠী: এরা উত্তর এশিয়ার তৃণভূমি অঞ্চল থেকে এসেছ, এছাড়া সুইডেন, নরওয়ে, বৃটেন ও রাশিয়ার কিছুলোক এই শ্রেণীর অর্ন্তভুক্ত।  

খ) অনার্য জনগোষ্ঠী (Non-Aryan):

আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে এদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী অনার্য নামে পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এরা বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।এরাই বাংলার আদি জনগোষ্ঠী এরা চারটি শাখায় বিভক্ত যথা :

1.অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড:

অস্ট্রোলয়েড  প্রাচীন বাংলায় একটি নৃ-গোষ্ঠী। নৃতত্ত্ববিদগণ এদেরকে আদি অস্ট্রেলীয় বলে  মনে করেন। এ জনগোষ্ঠীকে অস্ট্রিক বা অস্ট্রো-এশীয়ও বলা হয়। প্রাচীন সাহিত্যে এরা নিষাদ নামে পরিচিত। পন্ডিতদের মতে, অস্ট্রোলয়েডদের আদি বাসস্থান মধ্য ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারত এবং সিংহল থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কাল পরিক্রমায় তাদের একটি দল আদি বাসস্থান ত্যাগ করে বাংলায় অভিবাসন করে। বাংলার প্রাচীনতম বং জনগোষ্ঠীর পরবর্তী নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর পরে বাংলায় এদের আগমন ঘটে বলে অনুমিত হয়। এরা বাংলাদেশের কোল, ভীল,সাঁওতাল, ভূমিজ, মুন্ডা, বাঁশফোড়, মালপাহাড়ি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ রূপে চিহ্নিত।

2.নেগ্রিটো:

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আদিম জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর ভিতরে রয়েছে  আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ১২টি জাতিগোষ্ঠী, মালোয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের ৬টি সেমাং জাতিগোষ্ঠী এবং ফিলিপাইনের ৩০টি জাতিগোষ্ঠী।

3.দ্রাবিড় বা আদি অস্ট্রেলিয়:

দ্রাবিড়রা ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী এমন একটি নৃগোষ্ঠী যাার প্রাচীন দ্রাবীড় ভাষায় কথা বলত। প্রায় 4000 বছর ধরে এই ভাষাভাষী মানুষ এই অঞ্চলে বাস করে আসছে। দ্রাবিড়রাই হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতার রূপকার ছিলেন বলে মনে করা হয় । দক্ষিণ ভারতের বেশীরভাগ জনগোষ্ঠী দ্রাবিড়। আদি বসবাসকারি জনগোষ্ঠী হিসাবে দ্রাবিড় জনগনকে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান,নেপাল, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ এবং শ্রীলংকায় দেখতে পাওয়া যায়।

4.মঙ্গোলয়েড:

সুদূর উত্তর, পূর্ব এবং উত্তর এশিয়ার আদিবাসীরা মঙ্গোলয়েড জাতির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশে এই নির্দিষ্ট জাতির মধ্যে রয়েছে।বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর রক্তের মিশ্রণের কারণে তারা পাবল্য হারিয়েছে।বাঙ্গালিদরে মধ্যে এই জাতি গোষ্ঠীর রক্তধারার মিশ্রন রয়েছে। গায়ের রং পিতাভ - বাদামি। বাংলাদেশের লেপচা, ভুটিয়া, চাকমা, গারো, হাজং, মুরং, মেচ, খাসিয়া, মগ, ত্রিপুরা মারমা ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এই নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। 

এছাড়া কালেকালে ধর্মপ্রচার, ব্যবসাবাণিজ্য ও দেশজয় কিংবা দস্যু সম্রদায়ের লুটতরাজ করতে আসার সুবাদে এদেশে বিভিন্ন রক্তধারার লোকজনের আগমন ঘটে। মধ্য এশিয়া, পারস্য, ও তুরস্ক থেকে আসা শক,তুর্কি, পাঠান, মোগল, ইরানি, আবিসিনীয় এবং আরব জনগোষ্ঠী এদেশে এসে বসবাস করে এবং পরবর্তীতে ইংরেজ পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজদের সাথে এতদাঞ্চলের মানুষের রক্তধারা মিশেছে।এভাবে দেখা যায় বাঙ্গালি কোন বিশুদ্ধ নৃগোষ্ঠীগত জাতি নয়। এ জাতি গঠনে নানা ধরনের নরগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে।

নীহার রঞ্জন রায় এর মতে বাঙালি জাতির গঠনে অস্ট্রেলীয় তথা অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ রয়েছে।


বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহঃ

  1. আকারে খাটো থেকে মাঝারি

  2. মাথার চুল অধিকাংশের কালো, কিছু বাদামি

  3.  চুল সোজা, তরঙ্গায়িত এবং কুঞ্চিত

  4. গায়ের রং কালো থেকে হালকা বাদামি

  5. চোখের মনি কালো ও বাদামি

  6. মধ্যম আকৃতির নাক

  7. এ, বি এবং ও গ্রুপের রক্তের প্রধান্য


বিভিন্ন বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সংকরায়নের ফলে বাঙালি জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দাঁড় করানো অসম্ভব। একক কোন বৈশিষ্ট্য দ্বারা বাঙালিদেরকে চিহ্নিত করা যায় না।  কেননা এখানে বসবাসরত মানুষের একই ব্যক্তির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর নীতির বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মিলনের ফলে বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর চরিত্রেও  মিশ্র বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি লক্ষনীয়। আমাদের দৈহিক গড়ন, খাদ্যাভ্যাস, চালচলন, ভাষা-সংস্কৃতি, আচার আচরণ ইত্যাদির মাধ্যমে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।  





Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.

No comments:

Post a Comment