Breaking

Sunday 18 September 2022

মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন

 


মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন

(610-622)

[Prophethood and Eventful Meccan Life of Muhammad (PBUH)]


নবুওয়াত:

মহান আল্লাহর ঐশী বানী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার পদ্ধতিকে নবুওয়াত বা রিসালাত বলে। মানুষ পৃথিবীতে আগমনের পর থেকে আল্লাহ যুগে যুগে বহু নবী রাসূলকে মানুষের হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীতে প্রথম নবুওয়াতের দায়িত্বে মনোনীত হয়েছিলেন প্রথম মানুষ ও নবী- হযরত আদম (আ)। আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)। এ দুজনের মাঝে যুগে যুগে পথ ভোলা মানুষের হেদায়াতের জন্য আরও বহু নবী-রাসূল এসেছেন। নবী-রাসূলগণের আবির্ভাব না হলে সত্য ও আলোর সন্ধান মানুষ কোনক্রমেই লাভ করতে সক্ষম হতো না। নবী ও রাসূলগণ মহান আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে মনোনীত হয়ে যে নির্দেশনা ও দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন তাই নবুয়াত বা রিসালাত। 





 

রাসুলঃ

রাসুল হলেন তারা যারা ইসলাম প্রচার করার জন্য আল্লাহ দ্বারা নির্বাচিত বিশেষ ব্যক্তি । এবং তাদের উপর ওহী নাযিল তথা বিধান জারি করা হয়েছে অর্থ্যাৎ তারা আল্লাহর পক্ষথেকে কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন। 


নবীঃ

আর নবী হলেন যারা ইসলাম প্রচার করার জন্য আল্লাহ দ্বারা নির্বাচিত বিশেষ ব্যক্তি কিন্তু তাদের উপর কোনো ওহী নাযিল হয় না। অর্থাৎ তারা নতুন কোন কিতাব প্রাপ্ত হননি বরং তারা আগের রাসূলের উপর নাযিলকৃত কিতাবটিই প্রচার করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে সব রাসুলই নবী কিন্তু সব নবী রসুল নন । রাসূল কে, নবী এবং রাসূল উভয় ই বলা যায়।কিন্তু নবীকে, শুধু নবী ই বলতে হয় রাসূল বলা হয় না কারণ তিনি ওহী প্রাপ্ত হন নি।


উদাহরণ:

মুসা আ: ছিলেন নবী এবং রাসূল কারণ তার উপর তাওরাত(ওহী কিতাব) নাযিল হয়েছিল। এবং মুসা আ: এর ভাই হারুন আ: ছিলেন নবী কারণ তার উপরে কোনো ওহী নাযিল হয়নি ,তিনি তার ভাই মুসা আ: প্রাপ্ত কিতাব তাওরাত নবুয়তের দায়িত্ব পালন করেছেন ।


আরও পড়ুন-

বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং   হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী



মুহাম্মদ (সঃ) এর নবুওয়ত লাভঃ 


চল্লিশ বছর বয়সে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স:) নবুওয়ত লাভ করেন, অর্থাৎ এই সময়েই স্রষ্টা তার কাছে ওহী প্রেরণ করেন। নবুওয়ত সম্বন্ধে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণিত হাদীস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহী লাভ করেন। ত্রিশ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে (তিন মাইল দূরে অবস্থিত জাবালে নুর পর্বতের) হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী খাদিজা নিয়মিত তাঁকে খাবার দিয়ে আসতেন। এমনি এক ধ্যানের সময় মুহাম্মদ (স.) এর 40 বছর বয়সে 610 সালে রমজান মাসের লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে ফেরেশতা জিব্রাইল তার কাছে আল্লাহ প্রেরিত ওহী নিয়ে আসেন। জিব্রাইল তাঁকে বলেন “ইক্করা” অর্থাৎ পড়ুন, উত্তরে নবী জানান যে তিনি পড়তে জানেন না, এতে জিব্রাইল তাকে জড়িয়ে ধরে প্রবল চাপ প্রয়োগ করেন এবং আবার একই পংক্তি পড়তে বলেন। কিন্তু এবারও মুহাম্মাদ(স)নিজের অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। এভাবে তিনবার চাপ দেয়ার পর জীবরাঈল বলেন-


পড়ুন আপনার  প্রতিপালকের  নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে জমাট বাঁধা রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করুন আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত।যিনি মানুষকে কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন এমন জ্ঞান যা সে জানত না।” (সুরা আলাক্ব: আয়াত,১-৫)


এবার মুহাম্মাদ (স.) পংক্তিটি পড়তে সমর্থ হন। অবর্তীর্ণ হয় কুরআনের প্রথম আয়াত গুচ্ছ; সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত। প্রথম অবতরণের পর নবী এতই ভীত হয়ে পড়েন যে কাঁপতে কাঁপতে নিজ গ্রহে প্রবেশ করেই খাদিজাকে কম্বল দিয়ে নিজের গা জড়িয়ে দেয়ার জন্য বলেন। বারবার বলতে থাকেন, “আমাকে আবৃত কর”। খাদিজা (রাঃ)মুহাম্মাদ (স.)  এর সকল কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেন এবং ভীতি দূর করার জন্য তাঁকে নিয়ে নিজ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে যান। নওফল তাকে শেষ নবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন ।ধীরে ধীরে তিনি স্বাভাবিক হন। তারপর আবার অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী প্রত্যাদেশের জন্য। কিছুকাল ওহী আসা বন্ধ থাকে, একটি লম্বা বিরতির পর তাঁর কাছে দ্বিতীয় বারের মত ওহী আসে। এবার অবতীর্ণ হয় সূরা মুদ্দাস্‌সির-এর কয়েকটি আয়াত। এভাবে মুহাম্মদ (স.) নবুয়ত লাভ করেন। (বুখারি)



গোপনে ইসলাম প্রচার

সূরা মুদ্দাসসির অবতীর্ণ হওয়ার পর মোহাম্মদ সালাহ সালাম দাওয়াতের মিশন লাভ করে গোপনে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এই ক্ষেত্রে তিনি সর্বপ্রথম সেই সব লোকদেরকে দাওয়াত দিলেন যাদের সাথে রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক।  পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব এবং নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে যাদেরকে তিনি বিশ্বস্ত বলে মনে করেছেন,যারা সত্য, কল্যান এবং মঙ্গলকে পছন্দ করে, তাঁর সত্যবাদিতা ও ন্যায়-পরায়নতা  সম্পর্কে অবগত ছিল তাদের কাছেই তিনি প্রথম ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন।


এদের মধ্য থেকে এমন এক দল লোক তার দাওয়াত গ্রহণ করে যারা কখনোই মোহাম্মদ সালাহ সালামের সম্মান-মর্যাদা সততা ও ন্যায় পরায়ণতা সম্পর্কে কোনো প্রকার সন্দেহ করেনি। ইসলামের ইতিহাসে এই দলটি ‘সাবেকিনে আওয়ালিন’ বা প্রথম অগ্রবর্তী দল হিসেবে প্রসিদ্ধ। এদের মধ্যে শীর্ষ তালিকায় ছিলেন মোহাম্মদ (স.) এর সহধর্মিণী উম্মুল মু'মিনীন হযরত খাদিজা (রা),ক্রীতদাস যায়েদ ইবনে সাবিত,  চাচাতো ভাই আলী ইবনে আবু তালিব, বন্ধুবর আবু বক্কর সিদ্দিক । গোপনে ইসলাম প্রচারের প্রথম তিন বছরে প্রকাশ্যে 40 জন এবং অপ্রকাশ্যে 94 জন সহ মোট 134 জন ইসলাম গ্রহণ করে। 


আরও পড়ুন-

বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি,  Ethnographic identity of the Bengali nation


আল-কুরআনের প্রভাব:

এসময়ের গোপন দাওয়াতকে সহজ করে দিয়েছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি নাযিলকৃত আল-কোরআন এর প্রভাব। এ সময়ে কোরআনের যে সূরাগুলো নাযিল হয়েছিল সেগুলো ছিল দাওয়াতের প্রথম স্তর উপযোগী ছোট ছোট বাক্য সম্বলিত সূরা। এগুলোর ভাষা ছিল সাবলীলএবং হৃদয়গ্রাহী। এছাড়া এই আয়াতগুলো এমন সাহিত্যিক চমক ছিল যে শোনার সঙ্গে সঙ্গে তা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করতো এবং প্রতিটি কথার আবেদন তার বিবেকের কাছে তীরের মত বিদ্ধ হত। যে শুনতো তার মনেই তা স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করত এবং তা বারবার শোনা ও আবৃত্তি করার ইচ্ছা ইচ্ছা জাগতো। আল কোরআনের অলৌকিকতা গোপনে ইসলাম প্রচারের যুগে কাফির-মুশরিকদের মনে নতুন  চিন্তার রেখাপাত করেছিল। মক্কার নেতৃবৃন্দ দিনের আলোয় অন্যান্য লোকদেরকে কোরআন শুনতে নিষেধ করলেও রাতের আধারে তারা নিজেরাই কুরআনের তেলাওয়াত শোনার জন্য মুহাম্মদ এর গৃহের বাহিরে কান পেতে থাকতো। 


গোপন ইবাদত-বন্দেগী

গোপনে ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি এ সময় ইবাদত-বন্দেগিও গোপনে করা হতো। নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত লোক ছাড়া কেউই এ বিষয়ে জানতো না। সালাতের সময় হলে মুহাম্মদ (স.)আশেপাশের কোন পাহাড়ের ঘাঁটিতে চলে যেতেন। একবার তিনি আলী (রা.) কে সাথে নিয়ে সালাত আদায় করছিলেন এমন সময় তার চাচা আবু তালিব ঘটনা ক্রমে সেখানে উপস্থিত হন এবং তাদের ইবাদতের নতুন পদ্ধতি দেখে বিস্মিত হন। সালাত শেষে তিনি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন এটা কোন ধরনের ধর্ম। মুহাম্মদ (স.) জবাবে বলেছিলেন এটা আমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ) এর ধর্ম। আবু তালিব বলেছিলেন আমি যদিও এটা গ্রহণ করতে পারছি না তবে তোমাকে পালন করার অনুমতি দিলাম, কেউ তোমার পথে বাধা দিতে পারবে না। 


দারুল আরকাম

সুষ্ঠুভাবে গোপন দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং নওমুসলিমদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য মোহাম্মদ (স.) একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। এএই গোপন প্রতিষ্ঠানটি ছিল সাহাবী আরকামের বাড়ি বা দারুল আরকাম । এটি ছিল সাফা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ।এটি ইসলামের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নওমুসলিমরা এখানে একত্রিত হতেন, রাসুল সালাম এর থেকে ইসলামের শিক্ষা লাভ করতেন এবং দাওয়াতি কার্যক্রম এখান থেকে পরিচালিত হতো। 


প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার:

মুহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কী জীবনে নবুয়তের প্রথম তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচার করার পর আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশনা দিয়ে আয়াত নাযিল করেন।



এছাড়া আল্লাহ তা'আলা অন্যত্র বলেন-

”আপনি আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন” 

এসব আয়াতের মাধ্যমে মূলত প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।


এই নির্দেশনা পেয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম দুটি পন্থা অবলম্বন করলেন


  1. পারিবারিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ:

তিনি আব্দুল আব্দুল মুত্তালিবের উত্তরসূরি এবং মক্কার বিভিন্ন অভিজাত লোকদেরকে তার গৃহে আমন্ত্রণ জানান এবং ভোজসভার আয়োজন করেন। এভোজসভায় অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিল। পানাহার শেষে মোহাম্মদ (স.) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তাকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত কেউ তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি। তবে কিশোর আলী এ সময় মোহাম্মদ (স.) এর ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। 


  1. প্রত্যুষকালীন সমাবেশ:

একদিন প্রত্যুষে মুহাম্মদ (স.) সাফা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তৎকালীন আরবের প্রচলিত বিপদ সংকেত মূলক শব্দ “ইয়া সাবাহান” “ইয়া সাবাহান” বলে মানুষদেরকে আহবান করতে লাগলেন। সাধারণত কোন ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা থাকলে এভাবে আহবান করা হয়। আর যেহেতু আহবান টি করেছেন বিশ্বস্ত মুহাম্মদ (স.) সেহেতু তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তার সামনে জড়ো হলো৷ তখন মোহাম্মদ (স.) উপস্থিত লোকদের কে উদ্দেশ্য করে বললেন আমি যদি বলি এ পাহাড়ের পেছনে একদল শত্রু তোমাদের আক্রমন করার জন্য অপেক্ষা করছে তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?  তখন তারা সবাই বলল অবশ্যই বিশ্বাস করব, কারণ তুমিতো আল আমিন, সারা জীবনে  তুমি কখনো মিথ্যা কথা বলনি৷


তখন মুহাম্মদ (স.) উপস্থিত লোকদের কে তার রিসালাত এবং এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানান এবং এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে পরকালে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে বলে তাদেরকে সতর্ক করেন৷ তার এই আহ্বান তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারল না, আবার গ্রহণও করতে পারলো না৷ কেননা তারা কখনোই তাকে মিথ্যা বলতে শুনেনি ৷ কিন্তু এ সময় আবু লাহাব মুহাম্মদ সাঃ কে উদ্দেশ্য করে বলল; তাব্বাল্লাকা ইয়া মুহাম্মদ! আ লিহাজা জামা'তানা (হে মুহাম্মদ তুমি ধ্বংস হও, এ জন্যই কি তুমি আমাদেরকে একত্রিত করেছ?) ৷ এই বলে সে মুহাম্মদ সাঃ এর দিকে পাথর ছুড়ে মারল৷  এই পরিপ্রেক্ষিতে সুরা লাহাব নাযিল হয়৷ অতঃপর মুহাম্মদ (স.)মক্কার বিভিন্ন গোত্রের কাছে তার এই রিসালাতের বাণী প্রকাশ্যে পৌঁছে দিতে থাকেন। 



আরও পড়ুন-

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মামলুকদের অবদান



কুরাইশদের বিরোধিতাঃ

প্রকাশ্য দেওয়াতে তেমন কেউ সাড়া না দিলেও মুহাম্মদ (স.) তার দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। একদিন তিনি কাবায় উপস্থিত হয়ে প্রকাশ্যে লোকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকলে মুশরিকরাা এটাকে তাদের জন্য অপমানজনক মনে করে এর বিরোধিতা করে এবং আক্রমণ করে৷ মুহাম্মদ সঃ কে রক্ষা করতে গিয়ে হারেস বিন আবি হালা শাহাদাত বরণ করেন৷ 


কুরাইশদের বিরোধিতার কয়েকটি ধরন:

হযরত লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিনিধি দল যখন মক্কা একত্রিত হবে মোঃ আসলাম তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবেন এই ভেবে কুরাইশরা চিন্তিত হয়ে পড়ল দাওয়াত প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তারা ওয়ালিদ মুগিরার নেতৃত্বে একটি বৈঠক করে মোহাম্মদ জাদুঘর বলে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেয়কয়েকজন মুশরিক হজযাত্রীদের আসা বিভিন্ন পথে অবস্থান নেয় এবং তারা মোহাম্মদ ইসলাম সম্পর্কে তাদের বিভিন্নভাবে সতর্ক করে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম যেখানেই দাওয়াত দিয়েছিলেন তার চাচা আবু লাহাব পেছনে পেছনে গিয়ে তাদেরকে বলতো তোমরা ওর কথা শুনবে না হচ্ছে পাগল মিথ্যাবাদী জাদুকর। 



  1. প্রথমত তারা মোহাম্মদ সাঃ কে হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপ উপহাস এবং মিথ্যাবাদী বলে তারা প্রতিপন্ন করতো যাতে মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে যায়।


  1. দ্বিতীয়ত তাদের দ্বিতীয় পদ্ধতি ছিল মোহাম্মদ সাঃ এর শিক্ষাকে বিকৃত করা সন্দেহ অবিশ্বাস সৃষ্টি করা, মিথ্যা প্রপাগান্ডা করা দ্বীনের শিক্ষা এবং দ্বীনি ব্যক্তিদের নিরর্থক বিতর্কে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা যাতে তারা মোহাম্মদ (স.)থেকে দূরে থাকে এবং ইসলাম শিক্ষার সুযোগই না পায়।


  1. তৃতীয় পদ্ধতি ছিল ইসলাম পূর্ববর্তী কাহিনী গুলোকে মানুষের কাছে তুলে ধরে মানুষকে মোহাম্মদ (স.) থেকে বিমুখ করে রাখা৷ এই কাজের জন্য তারা নজর ইবনে হারেসকে নিয়োগ দেয়। নজর ইবনে হারেস আরব এবং আরবের বাইরে থেকে বিভিন্ন কিচ্ছা, গল্প, কাহিনী সংগ্রহ করে৷ মোহাম্মদ (স.) যেখানেই দাওয়াতী কাজ করতেন সেখানেই সেই সমস্ত গল্প কাহিনী শুনিয়ে সে মানুষকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করত। এমনকি এই নজর ইবনে হারেস কয়েকজন দাসী ক্রয় করেছিল। যখন সে কোন ব্যক্তি সম্পর্কে শুনত যে সে মোহাম্মদ (স.) এর প্রতি ও ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে তখন সে তার কোন একটা দাসীকে সেই ব্যক্তির পেছনে লেলিয়ে দিত ৷ ওই দাসী সেই ব্যক্তিকে গান শুনাতো, পানাহার করা তো এবং নানাবিধভাবে আনন্দ-ফূর্তিতে রাখার চেষ্টা করত। এক পর্যায়ে দেখা যেত যে সেই ব্যক্তির ইসলামের প্রতি আর কোন আকর্ষণে থাকে না৷  


  1. চতুর্থ পর্যায়ে তারা মানুষকে এই বলে বিভ্রান্ত করত যে, ইসলাম এবং জাহিলিয়াত এগুলো একই জিনিস, এক সময় এগুলো একসাথে মিশে যাবে৷ যেমন তারা রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে প্রস্তাব করেছিল যে এক বছর তিনি তাদের উপাস্যদের উপাসনা করবেন আর এক বছরে তারা তাঁর প্রভুর উপাসনা করবে৷  মুশরিকরা বলেছিল আপনি যদি আমাদের উপাস্যদের মেনে নেন তবে আমরাও আপনার আল্লাহর এবাদত করব৷ এগুলো ছিল মূলত ইসলামকে পূর্ববর্তী জাহিলিয়াতের সাথে মিশিয়ে ফেলার একটি  কৌশল ৷



কুরাইশদের বিরোধিতার কারণ: 

কুরাইশদের ইসলাম বিরোধীতার বেশ কিছু কারণ ছিল


  1. ধর্মীয়: 

আল্লামা শিবলী নোমানীর মতে অশিক্ষিত ও বর্বর জাতির একটা বিশেষত্ব হলো তারা তাদের পৈত্রিক রসম-রেওয়াজ বিরুদ্ধ সব কিছুকেই প্রতিহত করার চেষ্টা করে৷  কাজেই মোহাম্মদ (স.) যখন মূর্খ আরবদের প্রথা পদ্ধতি ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন, স্বাভাবিকভাবেই তারা বিরোধিতা শুরু করে অর্থাৎ তারা পূর্ববর্তীদের যে ধর্ম চর্চা করছে ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের সেই ধর্মীয় ঐতিহ্য ছাড়তে হবে যা তারা করতে  প্রস্তুত ছিল না ।


  1. অর্থনৈতিক :

মক্কার কুরাইশদের অর্থনৈতিক শক্তির অন্যতম উৎস ছিল হজ ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সময়ে কাবায় আগত লোকদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ ৷ মক্কা কেন্দ্রিক ব্যবসা, উকাজ মেলায় প্রতিযোগিতা, ধর্মীয় আচার উৎসব তাদেরকে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা দিয়েছিল। মোহাম্মদ (স.) যে দাওয়াত দিচ্ছেন এটা প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সে সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে সেজন্যই তারা বিরোধিতা শুরু করে৷ 


  1. রাজনৈতিক:

কুরাইশদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব হারানোর ভয় ছিল বিরোধিতার আরেকটি বড় কারণ। মক্কা কেন্দ্রিক পৌত্তলিকরা তখন নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিল। মুহাম্মদ (সঃ) এর দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণভাবে পৌত্তলিকতা বিরোধী। মুহাম্মদ সাঃ এর দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত হলে তারা নেতৃত্ব হারাবে, মুহাম্মদ (স.) এর দাওয়াতি মিশন আরবে কুরাইশদের নেতৃত্বকে জন্য একটি ভয়ঙ্কর হুমকিতে ফেলেছিল। মূলত নেতৃত্ব হারানোর ভয়েই তারা মুহাম্মদ সঃ এর  বিরোধিতা শুরু করে৷ 

  1. সামাজিক ও নৈতিকতা:

তৎকালীন আরব সমাজ মদ, জুয়া, নারী, যুদ্ধ ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত ছিল। ইসলামের দাওয়াত ছিল এ সমস্ত অপকর্ম ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। সুতরাং ইসলামের দাওয়াত এ সমস্ত কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে আঘাত হানে৷ মোহাম্মদ (স.) সালাম যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন তা তাদের ইচ্ছা এবং অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত৷ 


  1. আরবদের বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা:

আরবদের মধ্যে ভুল ধারণা ছিল যে, নবুয়ত প্রাপ্ত হতে হলে তাকে মক্কা বা তায়েফের সম্ভ্রান্ত বংশের লোক হতে হবে। তাছাড়া তাদের বিশ্বাস ছিল যে নেতৃত্ব এবং  নবুয়ত প্রাপ্ত হতে হলে নেতৃত্বের অনিবার্য গুণ হিসেবে সম্পদের প্রাচুর্য এবং অনেক ছেলে সন্তান থাকতে হবে। কিন্তু মুহাম্মদ (স.) এরসম্পদও ছিল না, কোন ছেলে সন্তানও ছিল না। বেশি সম্পদ ও বেশি সন্তান ছাড়া কেউ নেতা হতে পারে না। তাদের এই ধারণার কারণে তারা বিরোধিতা শুরু করে।


  1. অতিমানবিক ধারণা

কুরাইশদের একটি ধারণা ছিল নবী-রাসূল মানুষের মধ্য থেকে কেউ হতে পারে না। হলেও তিনি সাধারন মানুষের মত হবেন না বরং তার সঙ্গে শারীরিক ভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ব্যাপক পার্থক্য থাকবে। কিন্তু মুহাম্মদ (স.) কোন অতি মানব ছিলেন না। কাঠামোতে তিনি অন্যান্য মানুষের মতোই ছিলেন । সাধারণ মানুষদের প্রথাসিদ্ধ ধারণার সঙ্গে মিল না থাকায় তারা তাঁর দাওয়াত এর বিরোধিতা করে


আরও পড়ুন-



মুসলমানদের প্রতি কুরাইশদের নির্যাতন:

মুসলিম এবং মুহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কী জীবন ছিল এক দুঃসহ বেদনার জীবন। ইসলাম প্রচারের সাথে সাথে যেমন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তেমনি নও মুসলিমদের প্রতি কুরাইশদের নিপীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচারও ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিভিন্নভাবে তারা মুসলিমদের নির্যাতন করত; যেমন বন্দি রেখে মারপিট করা, খাবার না দেয়া, মরুভূমির গরম বালিতে শুইয়ে রাখা, নির্মমভাবে হত্যা করা, ঘোড়ার  পিছনে রশি বেঁধে  টেনে হেচড়ে নিয়ে যাওয়া এবং নামাজরত অবস্থায় মুহাম্মদ (স.) এর উপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তারা নির্যাতন করতো। 


কুরাইশদের এই নির্যাতনে সর্বপ্রথম হারেস ইবনে আবি হালা অতঃপর মহিলাদের মধ্যে সুমাইয়া শাহাদাত বরণ করেন। সুমাইয়ার স্বামী ইয়াসির এবং ছেলে আম্মার ইবনে ইয়াসির, বেলাল হাবশি, খাব্বাব, হযরত উসমান (রা) ইসলামের প্রথম দিকে কুরাইশদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। 


আবিসিনিয়ায় হিজরত:

মুহাম্মদ (সাঃ) এর মক্কী জীবনে প্রথম দিকে তিনি নির্যাতন থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকলেও নওমুসলিমরা মারাত্মকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। আরবের প্রতিবেশী রাষ্ট্র আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশীর ন্যায়পরায়ণতার কথা আবর জুড়ে খ্যাত ছিল। মুহাম্মদ (স.) নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য মুসলিমদেরকে আবিসিনিয়া হিজরতের নির্দেশ দেন। মুসলিমরা সর্বপ্রথম আবিসিনিয়ায় হিজরত করে৷ আবিসিনিয়ায় হিজরতের ঘটনা ঘটেছিল দুইবার। 


  1. আবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত :

মোহাম্মদ (স.) এর নির্দেশে নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে 615 খ্রিস্টাব্দে হযরত ওসমানের নেতৃত্বে তার স্ত্রী রুকাইয়া সহ চারজন মহিলা ও ১১ জন পুরুষ সহ মোট 15 জন আবিসিনিয়া হিজরত করেন৷ এই দলে জাফর ইবনে আবু তালিব ছিলেন৷ 


  1. আবিসিনিয়ায় কুরাইশদের প্রতিনিধিদল:

মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় হিজরতের সংবাদ শুনে কুরাইশরা তাদের প্রশ্চাতধাবন করে ধরতে ব্যর্থ হয়৷ কুরাইশরা একটি প্রতিনিধি দল বাদশা নাজ্জাসীর কাছে প্রেরণ করে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য৷ এ সময় জাফর ইবনে আবু তালিব বাদশাহের সামনে সুরা মরিয়ম তেলাওয়াত করেন এবং তিনি বক্তব্য দেন৷ জাফর ইবনে আবু তালিব এর কথা শুনে বাদশা মুগ্ধ হন এবং কুরাইশদের প্রতিনিধি দলকে তিনি আবিসিনিয়া ত্যাগ করার নির্দেশ দেন তিনি৷ মুসলিমদেরকে নিরাপদে আবিসিয়ায় থাকার অনুমতি দেন ৷


  1. আবিসিনিয়ায়  দ্বিতীয় হিজরত:

মক্কার অবস্থা পরিবর্তন হতে পারে ভেবে দুই মাস পর আবিসিনিয়ায় হিজরত কারীরা দেশে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু তখন মক্কায় মুসলিমদের উপর নিপীড়ন নির্যাতন আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে মোহাম্মদ (স.) পুনরায় মুসলিমদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের নির্দেশ দেন। 616 খ্রিস্টাব্দে 18 জন মহিলা সহ প্রায় 100 জন মুসলিম হিজরত করে। দ্বিতীয়বারেও হযরত ওসমান এবং তার স্ত্রী রুকাইয়া এই কাফেলাতে ছিলেন।  


আবিসিনিয়ায় হিজরত এর গুরুত্ব ও ফলাফল: 

  1. মক্কার বাড়িঘর সহায়-সম্পত্তি ত্যাগ করে মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় হিজরত কাফেরদেরকে কথা বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা ঈমান কখনো ছাড়তে রাজি নয়।

  2. আবিসিনিয়ায় মুসলিমদের নিরাপদ অবস্থান তাদেরকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করেছিল এবং একটি আশ্রয়স্থল তারা খুঁজে পেয়েছিল। 

  3. আবিসিনিয়ায় হিজরত ছিল মূলত মদিনায় চূড়ান্ত হিজরতের পূর্ব প্রস্তুতি। 

  4. বাদশা নাজ্জাশী আন্তরিকভাবে ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন ৷ মনেপ্রাণে ইসলাম গ্রহণ করলেও পারিপার্শ্বিক কারণে তা প্রকাশ করতে পারেন নি, কেননা তার মৃত্যুর খবর শুনে রাসূলুল্লাহ (স.) তার গায়েবানা জানাজা পড়েছিলেন। অন্যদিকে মক্কায় ইসলাম অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। 


আরও পড়ুন-



কুরাইশদের বয়কট নীতি বা শিয়াবে আবু তালিব

দিন দিন ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়াতে এবং ইসলামের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করতে না পেরে কোরায়েশরা এক ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। মুসলিম এবং একইসাথে বনু হাশেম গোত্রকে তারা বয়কটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নবুয়তের ৬ষ্ঠ বর্ষে 616 সালে তারা একটি চুক্তি পত্র তৈরি করে এবং তা কাবা ঘরে সংরক্ষণ করে। এই চুক্তিপত্রে অনুযায়ী-


  1. কুরাইশরা কেহই মুসলমানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না; 

  2. কুরাইশদেরকে ও মুসলমানদের পণ্য ক্রয় করবে না এবং তাদের নিকট পণ্য বিক্রয় করবে না;

  3. মুসলমানদের সাথে সর্বপ্রকার সামাজিক আদান-প্রদান ও আলাপ-আলোচনা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে;

  4. কেউ মুসলমানদের সাহায্য করলে তাকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে;

  5. যতদিন না হযরত মোহাম্মদ সাল্লাহ সালামকে হত্যার জন্য কোরাইশদের নিকট হস্তান্তর না করবে ততদিন এই অঙ্গীকার বলবৎ থাকবে। 


শিয়াবে আবু তালিব বা এই বয়কট ছিল মুসলিমদের জন্য একটি জেলখানা। মুসলিমদের সাথে এখানে বনু হাশেম এই বয়কটের  শিকার হয়। খাদ্য ও পানীয়ের তীব্র সংকটে মুসলিমদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠে। এদের সাথে সর্বপ্রকার লেনদেন বেচাকেনা বিনিময় এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। তিন বছর যাবত এই জেলখানায় মুসলিমরা নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে, কিন্তু তারপরেও মুসলিমরা ধৈর্যচ্যুত হননি।


বয়কট বা শিয়াবে আবু তালিব থেকে মুক্তি:

বনু হাশেম এর প্রতি অমানবিক নীতি বিবেকবান কোরাইশদের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাদের অনেকেই গোপনে গোপনে কিছু খাদ্যদ্রব্য পাঠাতেন। হিশাম ইবনে আমর মুসলমানদের এই বয়কট থেকে মুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া জুহাইর ইবনে আবু উমাইয়া, আবুল বুখতারী ইবনে হিশাম, মুতয়িম ইবনে আদি,  এবং আবু তালিবের বোন বিবি আতিকা মুসলমানদের পক্ষে কাজ করেন৷ যুহাইর সমমনা কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন৷ নির্দিষ্ট দিনে তিনি কাবা ঘরে সাতবার তাওয়াফ করে মক্কাবাসীদের সম্বোধন করে বললেন মক্কাবাসীরা শোনো, আমরা পানাহার করব, পোশাক পরিধান করব, আর বনু হাশেম ধ্বংস হয়ে যাবে এ অবস্থা আর চলতে পারে না। তিনি অঙ্গীকার পত্র বের করে ছিঁড়ে ফেলার জন্য উদ্যত হলে তাকে বাধা দেওয়া হয়। এদিকে ওহীর মাধ্যমে মোহাম্মদ (স.) জানতে পেরেছিলেন যে অঙ্গীকার পত্রটি পোকায় খেয়ে ফেলেছে। আবু তালিব তাৎক্ষণিক এই সংবাদ কাবা ঘরে এসে ঘোষণা করেন যে তোমাদের চুক্তিপত্র অবৈধ এবং এটি পোকায় খেয়ে ফেলেছে, যদি একথা সত্যি না হয় তাহলে মোহাম্মদ (স.) থেকে আমরা সরে দাঁড়াবো। অতঃপর তর্ক বিতর্ক শেষে অঙ্গীকার পত্র বের করে দেখা গেল শুধু আল্লাহ নামটি ছাড়া আর সমস্ত পত্রটি পোকা খেয়ে ফেলেছে। এর ফলে অঙ্গীকার পত্রটি ছিড়ে ফেলা হয় এবং এই বয়কটের অবসান ঘটে। যদিও ইসলামের প্রতি কুরাইশদের মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। 


কুরাইশদের আপস প্রস্তাব:

অতঃপর কুরাইশরা সম্মিলিতভাবে মোহাম্মদ সালাহ সালামের চাচা আবু তালিবের কাছে আপস প্রস্তাব পাঠায়। তারা বলে মুহাম্মদ (স.) যা চান থাকে তা ই দেয়া হবে। তিনি তাদের দেবদেবীর বিরোধিতা করবেন না এবং ইসলাম প্রচার করবেন না এই শর্তে মক্কার ক্ষমতা, সম্পদ, সুন্দরী নারী সবকিছু তাকে দেওয়া হবে৷ কুরাইশদের এই প্রস্তাবে মোহাম্মদ (স.) এর কছে উপস্থাপন করা হলে তিনি দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করের এবং  বললেন; যদি কেহ আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তবুও আমি ইসলামকে বর্জন করব না।


আমুল হুযন বা দুঃখ-কষ্টের বছর:

সিয়াবে আবু তালিব থেকে মুক্ত হওয়ার ৬ মাস পর রাসুল (স.) এর আশ্রয়স্থল চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন এবং এর কিছুদিন পরই তার বিশ্বস্ত সহধর্মীনী উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজা ইন্তেকাল করেন ৷ ইসলামের অন্যতম সাহায্যকারী এবং আশ্রয়স্থল স্ত্রী খাদিজা এবং চাচা আবু তালিব এর মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত শোকাতুর ও নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন৷ এ কারনে নবুয়তের দশম বছরকে বলা হয় আমল হুজুর বা দুঃখ কষ্টের বছর৷ 


তায়েফ গমন:

চাচা আবু তালিব ইসলাম গ্রহণ না করলেও মোহাম্মদ (স.) কে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও আশ্রয় দিয়েছিলেন। আবু তালেবের অনুপস্থিতিতে কুরাইশরা এবার সেই সুযোগ গ্রহণ করে এবং মুসলিমদের উপরে নিপীড়ন নির্যাতন বাড়িয়ে দেয়। এসময়ে রাসূলুল্লাহ (স.) পালক পুত্র জায়েদ ইবনে হারিসকে নিয়ে মক্কার 75 মাইল দক্ষিনে উর্বর শস্য-শ্যামল অঞ্চল তায়েফে গমন করেন। সেখানে তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকলে সাকিব গোত্রের প্রধান তার পিছনে উশৃংখল ছেলেদের লেলিয়ে দেয়। তারা মোহাম্মদ সাঃ কে পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করে এবং শহর থেকে বের করে দেয়। নি দশদিন তায়েফে ছিলেন অতঃপর তিনি মুতিম ইবনে আদির মধ্যস্থতায় মক্কায় প্রবেশ করেন। উল্লেখ্য যে, সময় বাহ্যত দৃষ্টিতে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ না করলেও এ সময় জিনদের একটি বিরাট দল রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে এসে ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করে যা পবিত্র কুরআনে বর্নীত হয়েছে ৷


মিরাজ গমন:

৬২০ অথবা ২১ খ্রিস্টাব্দে নবুয়তের ১১ তম বর্ষে, রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মিরাজ সংঘটিত হয়। ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে হযরত মুহাম্মদ সঃ এর মক্কা থেকে বাইতুল বায়তুল মুকাদ্দাসে উপনীত হওয়া এবং সেখান থেকে সপ্তাকাশ ভ্রমণ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হওয়ার ঘটনাকে মিরাজ বলে৷ মূলত মোহাম্মদ সাঃ এর চাচা এবং স্ত্রীর খাদিজার মৃত্যু অতঃপর তায়েফ গিয়ে তিনি যে জুলুমের শিকার হয়ে তিনি যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট অনুভব করছিলেন সে কষ্ট লাঘব করা এবং তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা মিরাজের মাধ্যমে তার সাথে সাক্ষাৎ দান করেন৷ মিরাজ থেকে এসে তিনি যখন মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করেন তখন সর্বপ্রথম আবু বকর এই মিরাজকে সত্য ঘটনা হিসেবে সত্যায়ন করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (স.) আবু বকরকে সিদ্দিক বা সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করেন৷


আরও পড়ুন-




ইয়াসরিবে (মদিনায়) ইসলাম এবং আকাবার শপথঃ


আকাবার প্রথম শপথ:

তায়েফ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মোহাম্মদ সাঃ হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় আগত আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দাওয়াত পেশ করতে থাকেন। এ সময়ে মক্কার আঁকাবা নামক উপত্যকায় ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রের ছয় জন ব্যক্তির সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং কোরআনের বিভিন্ন আয়াত পাঠ করে শুনান। কুরআন শুনে তারা বেশ প্রভাবিত হয় এবং তারা বুঝতে পারে যে ইহুদি এবং খ্রিস্টান আলেমরা সর্বশেষ যে নবী আসার কথা বলছিলেন তিনি সেই নবী৷ তারা তাৎক্ষণিক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং মদিনায ফিরে গিয়ে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করে৷ 


আকাবার দ্বিতীয় শপথ:

পরবর্তী বছর ৬২১ সালে আউস এবং খাজরাজ গোত্র থেকে মোট 12 জন লোক হজ্বের সময় আকাবার প্রান্তরে মোহাম্মদ সাঃ এর সাথে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা ইসলাম শিক্ষা দেওয়ার জন্য একজন সাহাবীকে মদিনায় প্রেরণের অনুরোধ করে। মুহ্ম্মদ (স.) হযরত মুসআবকে  কোরআন শিক্ষা ও ইসলাম প্রসারের জন্য ইয়াসরিবে প্রেরণ করেন৷


আকাবার তৃতীয় শপথ:

পরবর্তী বছর হজের মৌসুমে ইয়াসরিব থেকে  ৭৫ জন লোক হযরত মুহাম্মদ সঃ এর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে৷ এই দলে মহিলাও ছিলেন৷ ইসলাম গ্রহণের পাশাপাশি মদিনা ইসলাম প্রচার মোহাম্মদ সাঃ কে মদিনায় আমন্ত্রণ এবং ইসলামের জন্য তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে৷ 


আকাবা শপথের অঙ্গীকারসমূহ:

আকাবার শপথগুলোতে ইয়াছরিববাসী মুহাম্মদ এর সাথে যে সমস্ত বিষয়ে অঙ্গীকার করেছিল সেগুলো হচ্ছে-

  1. আমরা এক আল্লাহর ইবাদত করব এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করব না; 

  2. আমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হবো না;

  3. চুরিও ডাকাতি করবো না;

  4. কোন অবস্থায় শিশু হত্যা বা বলিদান করবো না;

  5. কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ করব না;

  6. কারো চরিত্রের প্রতি অপবাদ দেবো না;

  7. আমরা ঠকবাজি ও চুগলখুরী করব না;

  8. আমরা সকল ভাল কাজে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সাল্লাম কে মান্য করবো এবং কোন সঠিক কাজে তার অবাধ্য হবো না। 


আঁকাবার শপথের গুরুত্ব

আকাবার শপথগুলো ছিল মক্কায় অবস্থান করে মুহাম্মদ সঃ এর মদিনায় শক্তি বৃদ্ধির একটি কার্যকর প্রক্রিয়া ৷ প্রথম ছয় জন ইসলাম গ্রহণের পাশাপাশি তারা মোহাম্মদ সম্পর্কে এবং ইসলামের বিষয়ে মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকে৷ পরবর্তী  দলটিও একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে৷ এ সমস্ত পরিবারগুলো মূলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ইসলামের আদর্শ ও নির্দেশনায় পরিচালিত হচ্ছিল৷ সর্বশেষ 75 জন মদিনাবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পাশাপাশি মোহাম্মদ সঃ কে সর্বাত্মক নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করে৷ এদিকে তাদের আহবানে হযরত মূসাব মদিনায় গিয়ে মানুষকে কুরআন শোনাতেন৷ তাঁর কাছে কুরআন শুনে অনেক মদিনাবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে৷ যেহেতু তারা কোরআনের ভাষা বুঝতো ফলে সেখানে ইসলাম প্রচার খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল৷ এভাবে মদিনায় একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় যা ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে৷ 


আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ আলী পাশা এবং  আধুনিক মিসর     







Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.





No comments:

Post a Comment