Breaking

Wednesday 8 March 2023

রিদ্দার যুদ্ধঃ কারণ ঘটনা ও ফলাফল


 রিদ্ধার যুদ্ধঃ 

কারণ ঘটনা ও ফলাফল


মুহাম্মদ সাঃ এর ইন্তেকালের পর ইসলাম এবং আরব বিশ্ব এক ভয়াবহ আভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন হয়।স্বধর্ম ত্যাগীদের অপতৎপরতায় বিশ্ব স্রষ্টার একমাত্র জীবন ব্যবস্থা ইসলামের ভিত নড়বড়ে হয়ে উঠে। তখন রাসূলের যােগ্য উত্তরসূরি আবু বকর (রা) সংকটাপন্ন আরবে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ধর্ম ত্যাগীদের বিরুদ্ধে ফল অভিযান পরিচালনা করেন। দু’বছর তিন মাস শাসনামলের অধিকাংশ সময় তাকে রিদ্দা যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন- The short Chilaphate of Abu Bakar was mostly occupied with the so called Ridda wars.




  1. রিদ্ধার যুদ্ধের পরিচিতি:

রিদ্ধা আরবি শব্দ । এর অর্থ হচ্ছে ফিরে যাওয়া, প্রত্যাবর্তন করা। ঐতিহাসিকগন এই ফিরে যাওয়া মানে স্বধর্ম ত্যাগ করে পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যাওয়া কে  বুঝিয়েছেন। 


মুহাম্মদ (স.) এর ইন্তিকালের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর এক শ্রেণীর লোক বিশেষ করে যারা মক্কা বিজয়ের পর নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার লাভের আশায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা ইসলাম ত্যাগ করে পূর্ববর্তী ধর্মবিশ্বাসে প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করে। ফলে মুহাম্মদ (স.) এর ইন্তেকালের পর ইসলাম এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু হিজাজ ব্যতীত সমগ্র ভূখণ্ড ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে।  এ সময় কতিপয় ভন্ড নবীর আবির্ভাব ঘটে যারা ছিল এই বিদ্রোহের  মূল চালিকা শক্তি। ভন্ড নবী এবং বিদ্রোহীদের এই আন্দোলন হচ্ছে রিদ্ধা বা স্বধর্ম ত্যাগ আন্দোলন। এদের বিরুদ্ধে হযরত আবু বকর যে যুদ্ধ পরিচালনা করেন তাকে  রিদ্ধার যুদ্ধ বলে। 





  1. রিদ্ধার যুদ্ধের কারণসমূহ:


  1. ইসলাম প্রচারে সময়ের সল্পতা:

৬১০ সালে নবুয়ত প্রাপ্তির পর ৬৩২ সালে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মুহাম্মদ (স.) নবুয়তের মিশন প্রচারের জন্য সময় পেয়েছিলেন মাত্র ২৩ বছর। এই ২৩ বছরে কোরাইশ এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাকে বেশ কতগুলো যুদ্ধ করতে হয়েছিল। ফলে সমগ্র আরব ব্যাপী ইসলাম প্রচারে তিনি যথেষ্ট পরিমাণ সময় পাননি। তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল প্রাচীন। মুহাম্মদ সঃ এবং তার অনুসারীরা পায়ে হেঁটে, ঘোড়ায় কিংবা উঠে চড়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। রাসূলের জীবদ্দশায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ আরব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এদের সবাই আবার সম্পূর্ণরূপে ইসলামকে উপলব্ধি করতে পারেনি। যারা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ রূপে বুঝতে পারেনি এবং যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি তারাই রাসূলের ইন্তেকালের পরে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। যার পরিণতি রিদ্ধার যুদ্ধ। 


  1. ইসলামের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিরোধিতা:

ইসলাম ধর্ম আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করেছিল।মক্কা বিজয়ের পর যখন দ্রুত ইসলামের বিস্তার ঘটতে থাকে তখন যে সকল নও মুসলিমরা মুহাম্মদ সাঃ এর গভীর সঙ্গ এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও আদর্শ অনুশীলনের যথেষ্ট সময় পাননি তারা এই সমস্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে পারেননি। তারা যত দ্রুত ইসলামে প্রবেশ করেছিল রাসুলের ইন্তেকালের পরে তত দ্রুত বের হতে চাইলো। 


  1. আরবদের ব্যক্তি স্বাধীনতা:

গোত্রীয় শাসনে অভ্যস্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রিয় নওমুসলিম  আরবরা মনে করত ইসলামের ছায়াতলে এসে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে। ফলে রাসূলের ইন্তেকালের পর পর তারা ইসলাম থেকে বের হতে চাইলো। 


  1. গোত্রীয় শাসনের প্রভাব:

আরবের লোকেরা গোত্রপতিকে অন্ধের মত অনুসরণ করতো। রাসুলের জীবদ্দশায় অনেক গোত্রপতি রাসূলের কাছে বায়াত গ্রহণ করেছিল বলে সেই গোত্রের লোকেরাও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু রাসুলের ইন্তেকালের পরে যখন বিভিন্ন গোত্রীয় নেতারা বিরোধীতা শুরু করে তখন তাদের সাথে সাথে তার অনুসারীরাও ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে।  


  1. নৈতিক অনুশাসনের বিরোধিতা:

ইসলাম গ্রহণ করলে বেশ কিছু অনুশাসন মেনে চলতে হতো। ইসলামের বিধি নিষেধ, কঠোর নৈতিক অনুশাসন ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন নওমুসলিমরা মেনে নিতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে দুর্বল ঈমানদারেরা ইসলাম ত্যাগ করে পূর্ববর্তী ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে যেতে শুরু করে। ঐতিহাসিক আমির আলীর মতে - গোত্রীয় বিরুদ্ধাচারণের প্রথম কারণ ছিল ইসলাম ধর্মের কঠোর নৈতিক নিয়ম-কানুন। 



  1. মদিনার প্রাধান্যে ঈর্ষা:

বায়তুল্লাহ মক্কায় অবস্থিত হওয়ায় এতকাল যাবত আরবের নেতৃত্ব মক্কা থেকেই পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) মদিনায়  রাজধানী স্থাপন করলে সমগ্র আরব ব্যাপী মদিনার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। হেজাজের একটি শ্রেণী এ বিষয়ে রাসুলের জীবদ্দশায় তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তারা নীরব থাকলেও তাঁর ইন্তেকালের পর ইসলামী রাষ্ট্র মদিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। 


  1. যাকাতদানে অস্বীকৃতি:

যাকাত ইসলামের  ৫ম স্তম্ভের একটি এবং ইসলামী রাষ্ট্রের  অন্যতম আয়ের উৎস। আরবরা কখনোই বাধ্যতামূলকভাবে কাউকে কোন রাজস্ব বা যাকাত দেয়নি। তাই যাকাত প্রদান আরবদের কাছে বিশেষ করে নওমুসলিমদের কাছে ছিল অসহনীয় ব্যাপার। তারা মনে করেছে যাকাত প্রদান তাদের ব্যাক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং এতে সম্পদ কমে যায়।  ফলে তারা যাকাত দিতে অস্বীকার করে। 


  1. ভন্ড নবীদের আবির্ভাব:

নবুওয়াতকে পার্থিব ক্ষমতা এবং লাভজনক মনে করে আরবে বেশ কিছু ভন্ড নবীর আবির্ভাব ঘটে যা রিদ্ধার যুদ্ধে সবচেয়ে বড় কারণ। তারা গভীরভাবে মুহাম্মদ সঃ এর প্রথা ও রীতি পর্যবেক্ষণ করে সে অনুসারে নিজেরা শিক্ষা প্রচার শুরু করে। এ সময়-

  1. আসওয়াদ আনসি - ইয়ামেনে 

  2. মুসায়লামা - ইয়ামামায় 

  3. তুলাইহা - নজদে এবং 

  4. সাজাহ - ইরাকে 

নিজেদেরকে নবী বলে দাবি করে ধর্মত্যাগীদের উস্কানি দিতে থাকে। 


  1. অমুসলিমদের ষড়যন্ত্র:

আরবের ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক এবং মুনাফিকরা ইসলামের প্রধান শত্রু ছিল। তাদের অব্যাহত উস্কানি আরবের লোকদের স্বধর্মে  ফিরে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল। ইসলামের ক্ষতি সাধনে তারা সদা তৎপর ছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর ইন্তেকালের পর যখন তারা আরব মুসলমানের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও  অনৈক্য লক্ষ্য করল তখন তারা কুমন্ত্রণা দিয়ে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ইসলামকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। 




আরও পড়ুন-

বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং   হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী 




  1. রিদ্ধার যুদ্ধের প্রকৃতি ও ব্যাপ্তী:

রিদ্ধার যুদ্ধ ছিল একটি গৃহযুদ্ধ এবং এর ব্যাপ্তী ছিল সমগ্র আরব ব্যাপী । শুধু মক্কা এবং মদিনায় এর ক্রিয়াকলাপ কম ছিল। বিদ্রোহীরা ভন্ড নবীদের প্ররোচনায় বেশি উৎসাহিত হয়। হেজাজে প্রতিষ্ঠিত নতুন ইসলামী রাষ্ট্র মদিনাকে তারা নির্মূল করার জন্য আগ্রাসী হয়ে উঠে। হযরত আয়েশা (রা.) এর  বর্ণনা মতে- 

‘যখন হযরত মুহাম্মদ (স.) ইন্তেকাল করেন তখন আরববাসিরা স্বধর্ম ত্যাগ করে এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।  এতে সর্বত্র বিদ্রোহ শুরু হয়।  হযরতের ইন্তেকালের ফলে শীতের রাতের বৃষ্টিপাতে রাখালহীন মেষপালের মত মুসলমানরা দুরবস্থায় পতিত হয়, যতক্ষণ না আল্লাহ আবু বকরের নেতৃত্বে তাদেরকে একত্রিত করেন।’



  1. রিদ্ধার যুদ্ধের ঘটনাবলী:

  1. সামরিক বাহিনীর বিন্যাস:

চারিদিকে যখন বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা আর ছড়াছড়ি তখন আবু বকর এই বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দমন করার জন্য বদ্ধপরিকর হন। এই বিদ্রোহ ছিল মূলত ধর্ম ত্যাগীদের বিদ্রোহ।  তিনি মুসলিম সেনাবাহিনী পুর্নগঠন করেন এবং সেনাবাহিনীকে ১১ টি ভাগে বিভক্ত করেন।  একজন অভিজ্ঞ সেনাপতির দায়িত্বে প্রতিদলকে বিভিন্ন দিকে প্রেরণ করেন।যেমন-


  1. খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রথমে তুলাইহা এবং পরে মালিক বিন নুবিয়ারের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন; 

  2. ইকরামা বিন আবু জেহেলকে মুসায়লামার  বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন; 

  3. সোহরাবিলের নেতৃত্বে আরেকটি বাহিনী ইকরামার সাহায্যে প্রেরণ করেন; 

  4. মুহাজির বিন আবু উমাইয়াকে ইয়ামেনে এবং হাজরামাউতের প্রেরণ করেন; 

  5. সিরিয়ার সীমান্ত নিরাপত্তায় একটি বাহিনী প্রেরণ করেন; 

  6. আম্মানে বিদ্রোহ দমনে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন; 

  7. মাহরাহ এর বিদ্রোহ দমনে একটি দল প্রেরিত হয়; 

  8. খোঁজা গোত্রের বিদ্রোহ দমনে একটি বাহিনীর প্রেরণ করেন; 

  9. বুনু সালাম এর বিরুদ্ধে একটি দল প্রেরিত হয়;  

  10. হাওয়াজীন গোত্রের বিরুদ্ধে একটি দল প্রেরণ করেন;

  11. মদিনার নিরাপত্তা বিধানের জন্য ১১ তম বাহিনীকে আবু বকর নিয়োজিত রাখেন।


  1. আসওয়াদ আনসিকে দমন:

ইয়ামেনের আনসি গোত্রের নেতা আসওয়াদ আনসি রাসুলের জীবদ্দশায় সর্বপ্রথম নবুওয়াত দাবি করেন।  আনসি গোত্রের লোকেরা তাকে সমর্থন দেয়। সে ইয়েমেনের মুসলিম গভর্নরকে হত্যা করে রাজধানীর সানা দখল করে নেয়। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গোত্র প্রধানদের সহযোগিতায় সে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করে। রাসূলুল্লাহ তার ইন্তেকালের পূর্বেই আসওয়াদ আনসির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রেরণ করেন।  এবং রাসুলের ইন্তেকালের দুই এক দিন আগে গভর্নরের আত্মীয় ফিরোজ দায়লামী কর্তৃক আনসি নিহত হন। এদিকে রাসুলের ইন্তেকালের সংবাদ ইয়েমেনে পৌছলে তার অনুসারীরা পুনরায় বিদ্রোহ করে। অতঃপর আবু বকর তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে ইয়েমেনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।   


  1. সাজাহ ও মালিক বিন নুবিয়ারের পতন

ভন্ড মহিলা নবী সাজাহ মধ্য আরবের বনু ইয়ারুব গোত্রের এক খ্রিস্টান নারী ছিলেন। বনু তামিম গোত্রের নেতা মালিক বিন নুবিয়ার ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে সাজাহকে সমর্থন করে। সে আরেক ভন্ড নবী মুসালামাকে বিবাহ করে বিদ্রোহকে শক্তিশালী করে। তিন দিন মুসায়লামার সাথে অবস্থানের উপর সে পুনরায় বনু তামিম গোত্রে ফিরে আসলে খালিদ বিন ওয়ালিদ বনু তামিম গোত্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে মালিক বিন নুবিয়ারকে হত্যা করেন। অতঃপর সাজাহ দীর্ঘকাল নিষ্ক্রিয় থাকে এবং পরবর্তীতে সে  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। 



 

  1. তুলায়হাকে দমন:

তুলায়হা নজদে নিজেকে নবী বলে ঘোষণা করলে গাফতান ও  আসাদ গোত্র তাকে সমর্থন দেয়। খলিফা আবু বকর খালিদ বিন ওয়ালিদকে তুলাইহার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।  খালিদ বিন ওয়ালিদ যুদ্ধে তুলায়হাকে পরাজিত করেন। গাফতান ও  আসাদ গোত্রকে ক্ষমা করা হয়। তুলায়হা সপরিবারে সিরিয়া চলে যান। পরবর্তীতে মদিনায় এসে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। 


  1. মুসায়লামার পতন:

আরবের ইয়ামামার বনু হানিফা গোত্রের মুসায়লামা রাসুলের জীবদ্দশাতেই নিজেকে নবী বলে দাবি করেন। ভন্ড নবীদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। সাজাহকে বিবাহ করে সে আরো বেশি শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। সে কুরআনের বাণী নকল করে প্রচার শুরু করে। সে ৪০ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনী গঠন করে। খলিফা আবু বকর (রা.) মুসায়লামার বিরুদ্ধে প্রথমে ইকরামা ইবনে আবু জেহেলকে এবং তার সহযোগিতায় সুহরাবিলকে প্রেরণ করেন। কিন্তু মুসায়লামা মুসলিম বাহিনীকে পরাজিত করেন। অতঃপর আবু বকর মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদকে মুয়লামার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। ৬৩৩ সালে ইয়ামামার যুদ্ধে খালেদ বিন ওয়ালিদ মুসায়লামাকে পরাজিত করেন। প্রাচীর ঘেরা একটি বাগানে এই যুদ্ধটি অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় দশ হাজার বিদ্রোহী নিহত হয় এবং প্রচুর হাফেজে কোরআন শাহাদাত বরণ করে। ঐতিহাসিক তাবারি এই যুদ্ধকে মৃত্যুর বাগান (The Garden of Death/হাদিকাতুল মাওত) বলে অভিহিত বরেন।  


  1. বাহরাইনে বিদ্রোহ দমন:

মুহাম্মদ (স.) এর ইন্তেকালের কিছুদিন পর বাহরাইনের বকর গোত্র ইসলাম ত্যাগ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অন্যদিকে বনু কায়েস নামে একটি গোত্র ইসলামের প্রতি দৃঢ় ছিল। গোত্রের মধ্যে উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে বনু কায়েস গোত্র খলিফার সাহায্য কামনা করে। অন্যদিকে বনু বকর গোত্র পারস্যের সাহায্য কামনা করে। পারস্যের সহযোগিতা নিয়ে বনু বকর গোত্র বনু কায়েসের উপর আক্রমণ করে। ইতিমধ্যে খলিফার সাহায্যকারী বাহিনী  এসে পৌঁছে। মুসলিমবাহিনী বনু বকর এবং পারস্যের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে বিদ্রোহ দমন করে।  


  1. হাজরামাউতে বিদ্রোহ দমন:

হাজরামাউতের কিন্দা গোত্রের নেতা আল আশাখ বিন কায়েস ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে বিদ্রোহী হয়। খলিফার নির্দেশে ইকামা ইবনে আবু জেহেল এবং মুহাজীর ইবনে আবু উমাইয়া হাজরামাউতের সর্বত্র বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা দমন করেন। বিদ্রোহী নেতা আল আশাখ মুসলমানদের হাতে পরাজিত ও বন্দী হয়ে মদিনায় আনিত হন।  খলিফা থেকে ক্ষমা করেন এবং  সে আবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । 


  1. যাকাত অস্বীকারকারীদের দমন

হযরত আবু বকর (রা)-এর শাসনামলে বেশ কিছু গােত্র  যাকাত দিতে অস্বীকার করে। এমনকি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা মদিনার চারদিকে এসে ছাউনি ফেলে।হযরত আবু বকর (রা) তাদের বিরুদ্ধে হযরত আলী, তালহা, যুবায়ের (রা) প্রমুখকে প্রেরণ করেন। মাত্র একদিনের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়ে পুনরায় যাকাত প্রদানে সম্মত হয়।


  1. অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন

খলিফার প্রেরিত বাহিনী আম্মান ও মাহরাহ এর বিদ্রোহ দমন করে।  কাজা গোত্রের বিদ্রোহ সফলতার সঙ্গে দমন করা হয়। বনু সালাম ও বনু হাওয়াজীন গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত খলিফার বাহিনী দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। ফলে গোটা আরবে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়



আরও পড়ুন-

মারওয়ান: পরিচিতি উত্থান এবং খিলাফত লাভ



  1. রিদ্ধার যুদ্ধের ফলাফল:


  1. খিলাফতের অস্তিত্ব রক্ষা:

রিদ্দার যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হলে ইসলামি খিলাফতের অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যেত। শিশু ইসলামী রাষ্ট্র অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। পুনরায় পৌত্তলিকতার সয়লাভ ঘটত।  রিদ্দার যুদ্ধে জয়ী হয়ে মুসলিমরা আশু ধ্বংসের সম্ভাবনা থেকে ইসলামকে রক্ষা করে এবং ইসলামী খিলাফতকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে


  1. আরব ভূখণ্ড জয়:

রিদ্দার যুদ্ধে জয় লাভের মাধ্যমে মুসলিমরা আরব ভূখণ্ড জয় সম্পন্ন করে। ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক, প্রকৃতিবাদী এবং কাফিরদের আধিপত্যের চিরবিদায় ঘটে।  গোটা আরব ভূখণ্ডে ইসলামের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।  এজন্য পি.কে হিট্টি বলেছিলেন- বিশ্বজয়ের পূর্বে আরবদেরকে নিজেদের দেশকেই জয় করতে হয়েছিল। 


  1. ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা:

ধর্ম ত্যাগীরা ইসলামী রাষ্ট্র মদিনাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে শিশু ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং মদিনা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি মহানবী (স) নিজ হাতে স্থাপন করেছিলেন, তা হযরত আবু বকরের হাতে সুদৃঢ় হয়।


  1. রাষ্ট্রীয় ও খন্ডতা রক্ষা:

রিদ্দার যুদ্ধে মুসলিমরা পরাজিত হলে বিদ্রোহী সব গোত্র নিজ নিজ এলাকায় নতুন নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করত। ফলে আরব ভূখণ্ড খন্ড খন্ড বিশ্বাস ও আদর্শের রাষ্ট্রে পরিণত হতো। ইসলাম এবং আরব ভূখণ্ডের অখণ্ডতা কোনটাই রক্ষা পেত না। সুতরাং রিদ্দার যুদ্ধে বিজয় ইসলামের বিজয়। 

 

  1. আবু বকরের দৃঢ়তা:

অত্যন্ত নম্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী খলিফা আবু বকর কতটা ইস্পাত কঠিন হতে পারেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় রিদ্দার যুদ্ধে। ইসলাম রক্ষার্থে আবু বকর যথাসময়ে বিরাট ঝুঁকি গ্রহণ করেন। আবু বকরের সঠিক সিদ্ধান্ত এবং দৃঢ়তার কাছে গোটা আরব বিশ্ব নতি স্বীকার করে। 


  1. ধর্মীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা:

রাসুলের ইন্তেকালের পরে ধর্ম ত্যাগীরা ইসলাম ধর্মের ঐক্যকে মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করেছিল। ইসলামের এইরকম পরিস্থিতি দেখে অনেক মুসলমানের মনেও সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল। রিদ্দার যুদ্ধে জয় লাভের ফলে সমস্ত সংশয় ভুলে গিয়ে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। 


 

  1. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি

রিদ্দার যুদ্ধে জয় লাভের মাধ্যমে যাকাত অস্বীকারকারীদের দমন করে পুনরায় যাকাতের বিধান কার্যকর করা হলে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে। 

 

  1. রাজনৈতিক বিজয়:

রিদ্দা যুদ্ধে বিজয়ের ফলে আরব উপদ্বীপে ইসলামের রাজনৈতিক  ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর স্থায়িত্বের বুনিয়াদ দৃঢ় হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের ফলাফল যেমন ভয়ানক হতো ঠিক তেমনি বিজয় ছিল বড় ধরনের রাজনৈতিক বিজয়। 


  1. বিশ্ব বিজয়ের সূচনা:

রিদ্দার যুদ্ধে আরব ভূখণ্ড জয় করে মুসলিমরা বিশ্ব বিজয়ের পথ সুগম করে। এই যুদ্ধে রোমান ও পারসিকরা বিদ্রোহীদের সহায়তা করে বিধায় ভবিষ্যৎ সামরিক অভিযানের জন্য মুসলিমরা ইস্যু পেয়ে যায়। পরবর্তী ফলাফল হিসেবে মুসলিমরা পারস্য ও রোমান অধিকৃত অঞ্চল অধিকার করে। 


  1. কুরআন সংকলনের সুত্রপাত:

ভন্ড নবী দমন করতে গিয়ে ইয়ামামার যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক হাফেজে কোরআন নিহত হলে কুরআনের বিশুদ্ধতা ও সংরক্ষনের জন্য  কুরআন সংকলনের দাবি উঠে। এই বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত জীবিত হাফেজে কোরআন এবং অহী লেখকদের মাধ্যমে হযরত আবু বকরের যুগেই কোরআনের প্রথম সংকলন গ্রন্থবদ্ধ হয়। 


  1. গভীর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিঃ

 এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বিদ্রোহী গােত্রগুলাে আন্তরিকভাবে ইসলামে দীক্ষিত হলে যে আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, তা ইসলামকে এক বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে উপনীত করে।


  1. পৌত্তলিকতার অবসানঃ 

এ যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের ফলে আরব ভূখণ্ড থেকে পৌত্তলিকতা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে সেখানে একত্ববাদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।



আরও পড়ুন-
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা 



আরও পড়ুন-

মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল



আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন




রিদ্দার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

রিদ্দার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

রিদ্দার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

রিদ্ধার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

রিদ্ধার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

রিদ্ধার যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল





গ্রন্থপঞ্জি:


  1. P.K, Hitti, History of the Arabs, third edition revised, Macmillan and Company Limited, London,1946, 

  2. Sayed Amir Ali, A Short History of the Saracens, Macmillan and Company Limited, London, 1916

  3. S.W, Muir, The Caliphate, its Rise, Decline & Fall, The Religious Tract Society, Piccadilly, London. 1891

  4. পি,কে হিট্টি, আরর জাতির ইতিহাস , (বাংলা অনুবাদ)

  5. সৈয়দ আমীর আলী, আরব জাতির ইতিহাস, (বাংলা অনুবাদ)

  6. প্রফেসর ড. মো আতিয়ার রহমান ও ড. মো. ইব্রাহীম খলিল,মুসলমানদের ইতিহাস (৫৭০-৭৫০)

  7. মোহা. আল মুস্তানছির বিল্যাহ, ইসলামের ইতিহাস: হযরত মুহাম্মদ (সা.), খোলাফায়ে রািশেদিন ও উমাইয়া খিলাফত

  8. মাহবুবুর রহমান,মুসলমানদের ইতিহাস (570-1517), বুকস ফেয়ার, ঢাকা, 2015






Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.




No comments:

Post a Comment