Breaking

Friday 28 July 2023

ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবঃ কারণ, বিকাশ, গতি-প্রকৃতি ও ফলাফল

 


ঔপনিবেশিক শাসনামলে  ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবঃ  

কারণ, বিকাশ, গতি-প্রকৃতি ও ফলাফল 


ভারতে প্রধানত হিন্দু এবং মুসলিম এই দুটি সম্পদের বসবাস।  দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে ভারতে হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাথে ক্ষমতাসীন মুসলিমদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত  থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ ও উপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটে। ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজনৈতিক কারণে তারা হিন্দুদেরকে কাছে টেনে নেয় এবং মুসলিমদেরকে দূরে রাখে।  তাদের গৃহীত বিভিন্ন নীতির কারণে হিন্দু এবং মুসলিমদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং তারা পরস্পর পরস্পরকে শত্রু ভাবতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটে। মুসলিমরা তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পুঁজি করে ইসলামী জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করে অন্যদিকে হিন্দুরা তাদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। এই সাম্প্রদায়িকতা একসময় চরম বিকাশ লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিজয় ঘটে এবং সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়। 






ক. উপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবের কারণসমূহ:


  1. ব্রিটিশদের হিন্দু তোষণ নীতি:

যেহেতু ব্রিটিশরা মুসলমানদের থেকে ক্ষমতা দখল করেছে, সেহেতু তারা মুসলমানদেরকেই তাদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভাবতে শুরু করে এবং সমর্থক বলয় তৈরি করার জন্য  হিন্দু তোষণ নীতি গ্রহণ করে। মুসলিমদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে হিন্দুদেরকে তারা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাছে টেনে নেয়। ফলশ্রুতিতে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যা সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে। 



  1. ব্রিটিশদের “ভাগ কর ও শাসন কর” নীতি:

ভারতে ব্রিটিশ সরকারের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম কারণ। ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং  সংঘাত জিইয়ে রেখে নিজেদের শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘায়িত করা। এজন্য তারা হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি মীমাংসা না করে আরও বেশি উসকে দেয়। 


  1. সরকার কর্তৃক ইচ্ছাকৃত বৈষম্য সৃষ্টি:

সরকার মুসলিমদেরকে প্রতিপক্ষ মনে করে হিন্দুদেরকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করে নিজেদের সমর্থক বলয় তৈরি করে।  সরকারি সুবিধা প্রাপ্ত হয়ে হিন্দুরা অনেকটা অগ্রসর হয়ে গেলে হিন্দু এবং মুসলিমদের মাঝে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে অফিস আদালত.  শিক্ষা দীক্ষা. ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রেই হিন্দুরা একচেটিয়া ভাবে এগিয়ে যায়।  সর্বদিক দিয়ে সুবিধা বঞ্চিত মুসলিমরা হিন্দুদেরকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে।  যা সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। 


  1. মুসলিমদের ব্রিটিশ বিরোধী  মনোভাব: 

পলাশী এবং বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমতা হারানো মুসলিমরা কখনোই ব্রিটিশ শাসনকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। ব্রিটিশদেরকে প্রতিপক্ষ ভেবে মুসলিমরা সর্বদাই ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব পোষণ করত। অন্যদিকে হিন্দুরা ব্রিটিশদেরকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করে। এই দ্বিমুখী অবস্থানের কারণে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। 



  1. চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কার্যকারিতা: 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কার্যত হিন্দু সমাজ এবং হিন্দু জমিদারদের উন্নতি ও বিকাশ সাধিত হয়। সাধারণ মুসলিমদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এমনকি মুসলিম অভিজাদের পতন ঘটে। মুসলিমদের লাখেরাজগুলো বাতিল করা হয়।  মুসলিমরা এটা উপলব্ধি করে যে ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত সমস্ত নীতি মুসলিমদের ক্ষতিসাধন এবং হিন্দুদেরকে তোষন করার জন্যই গ্রহণ করা হয়। 


  1. কংগ্রেসের মুসলিম বিরোধী মনোভাব:

১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দু এবং মুসলিমে উভয়ই  ভারতীয় রাজনীতির সাথে যোগদান করতে শুরু করে। কিন্তু মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো কংগ্রেস সর্বদা এড়িয়ে যায় এবং মুসলিম অধিকারের বিষয়ে তারা সাম্প্রদায়িক আচরণ করতে শুরু করে। কংগ্রেস একটি হিন্দু প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠে এবং এর সমস্ত সিদ্ধান্ত মুসলিমদের স্বার্থের প্রতিকূলে যায়। ফলশ্রুতিতে মুসলিমরা ভাবতে থাকে যে কংগ্রেস এর মাধ্যমে মুসলিমদের স্বার্থ আদায় হবে না ফলে তারা কংগ্রেস বিরোধী হয়ে ওঠে। 


  1. স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ভূমিকা:

সৈয়দ আহমদ খান এর আলিগড় আন্দোলন ছিল মুসলিম সম্প্রদায় কেন্দ্রিক আন্দোলন। তিনি মুসলিমদের বুঝাতে চেষ্টা করেন যে  হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা, জাতি তাদের স্বার্থও আলাদা এবং এই দুই সম্পদের ঐক্যও অসম্ভব।  কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর পরই সৈয়দ আহমদ খান মুসলিমদেরকে কংগ্রেসে যোগদান করতে নিষেধ করেন। মুসলিমদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি কংগ্রেসের চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের উপর বেশি ভরসা করার পরামর্শ দেন । তিনিই প্রথম দ্বিজাতি তত্ত্বের সূত্রপাত করেন। 


  1. হিন্দু জাতীয়তাবাদ: 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতের প্রাচীন সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশ শুরু হয়। দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজ ও শুদ্ধি আন্দোলন, বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সাহিত্য, তিলকের শিবাজী ও গণপতি উৎসব, অরবিন্দ ঘােষ ও বিপিনচন্দ্র পালের আন্দোলনের ভাবধারায় কালী ও দুর্গার মাতৃমূর্তির প্রচার প্রভৃতি ঘটনা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রমোট করতে থাকে। তাদের সাহিত্য বক্তব্য ও কথাবার্তায় মুসলিমদের প্রতি নেতিবাচক বর্ণনা এবং ব্রিটিশদের প্রশংসা করা হতো।


  1. মুসলিম জাতীয়তাবাদ

হিন্দুদের এরকম জাতীয়তাবাদ দেখে মুসলিম আলেম সমাজ এবং কবি সাহিত্যিকগণ মুসলিম জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পান।  বিশেষ করে সৈয়দ আহমদ খান, সৈয়দ আমির আলী, নবাব আব্দুল লতিফ এর কল্যাণে মুসলিম জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়। সৈয়দ আহমদ খান এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রথম মুসলিম জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত করেন। 



  1. হিন্দু মহাসভার ঘোষণা : 

ব্রিটিশ আশীর্বাদপুষ্ট হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করে যে, মুসলমানরা অনেকেই ধর্মান্তরিত হিন্দু, তারা যদি ভারতীয় উপমহাদেশে থাকতে চায় তাহলে তাদেরকে পুনরায় হিন্দু হতে হবে, নইলে তারা বিবেচিত হবে বহিরাগত হিসেবে। এ ঘোষণা ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িকতা উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ।



  1. সাম্প্রদায়িক সংগঠন সৃষ্টি :

ঔপনিবেশিক শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দুরা জমিদারি অ্যাসোসিয়েশন (১৮৩৭), বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪৩), সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অব ন্যাশনাল ফিলিং (১৮৬৬), হিন্দু মহাসভা (১৯১৫) এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬) সংগঠন গড়ে তোলেন। মুসলমানরাও মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি (১৮৬৩), ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৭) এবং স্থানীয় পর্যায়ে অসংখ্য আঞ্জুমান  প্রতিষ্ঠা করেন, যা উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা উদ্ভবে দায়ী ছিল ।


  1. বঙ্গভঙ্গ ও রদ:

রাজনৈতিক কারণসহ নানাবিধ কারণে 1905 সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করলে তাতে মুসলিমরা উপকৃত হয়। এর বিরুদ্ধে হিন্দুরা চরম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। মুসলিমদের এই সুবিধা হিন্দুরা মেনে নিতে পারেনি। তাদের বিরোধিতা ও আন্দোলনের প্রেক্ষিতে  সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং 1911 সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে মুসলিমরা চরমভাবে ক্ষুদ্র হয়। 


  1. মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা:

১৯০৬ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ঢাকায়। এটি মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে এর সমস্ত সদস্য ছিল মুসলমান। মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতি কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে করে হিন্দুরা অসন্তুষ্ট হয় এবং তারা কংগ্রেসের মাধ্যমে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে হিন্দু এবং মুসলিমের বৈরিতা সাম্প্রদায়িকতাকে বিকশিত করে।


  1. বেঙ্গল প্যাক্ট এর ব্যর্থতা:

১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ প্যাক্ট  হিন্দু মুসলিমদের বৈরিতাকে প্রশমিত করে করে তাদেরকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাস বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিরসনের প্রয়াস চালান। কিন্তু মুসলিমদেরকে অধিক সুবিধা প্রধান কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে বেঙ্গল প্যাক্ট ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুটতে হিন্দু মুসলিম মিলনের সর্বশেষ প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। এরপর আর কখনোই হিন্দু মুসলিম একই প্লাটফর্মে আসেনি। 


  1.  নেহেরু রিপোর্ট এবং জিন্নাহ এর ১৪ দফা:

সাইমন কমিশনের দেওয়া চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কংগ্রেস 1928 সালে সর্বদলীয় বৈঠকের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে যা নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত। এই রিপোর্টে স্বতন্ত্র নির্বাচন মন্ডলী এবং নির্বাচনী আসন বন্টন নিয়ে মুসলিম স্বার্থকে উপেক্ষা করা হয়।  ভারতে মুসলিমরা যে একটি স্বতন্ত্র জাতি তা এই রিপোর্টে স্বীকার করা হয়নি। ফলে এটি  নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি ব্যতীত তেমন কিছুই উপহার দিতে পারেনি। এই প্রস্তাবের সংশোধনী হিসেবে জিন্নাহ চৌদ্দ দফা ঘোষণা করলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। এ সময় ভারতে সাম্প্রদায়িকতা মোটামুটি যৌবনে পদার্পণ করে। 


  1. গোলটেবিল বৈঠকের ব্যর্থতা: 

ভারতীয় সাংবিধানিক সমস্যা দূর করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে ১৯২৯, ১৯৩১ এবং ১৯৩২ সালে পরপর তিনটি গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সম্প্রদায়গুলি কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি ছিল না। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতার কারণে প্রত্যেকটি গোল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতার সমাধান করতে পারেনি। 


  1. ১৯৩৭ সালের নির্বাচন পরবর্তী কংগ্রেসের ভূমিকা:

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে মুসলিম লীগ যুক্তভাবে মন্ত্রীসভা গঠনের প্রস্তাব করলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে । এদিকে বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে । কিন্তু জুন মাসে কংগ্রেস ৬টি প্রদেশে এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে । কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে যুক্তপ্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস প্রদেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকে। বিভিন্ন অফিস-আদালতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কংগ্রেসের পতাকা ও বন্দেমাতরম সঙ্গীতের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে। এতে হিন্দু-মুসলিমের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয় ।


  1. দ্বিজাতি তত্ত্বের ঘোষণা

এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম জাতি তাদের নিজস্ব ভাগ্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। এ সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার দ্বি-জাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। স্যার সৈদ আহমদ খান কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তিনি দ্বিজাতি তত্ত্ব ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে জাতিসত্তার যে কোন সংজ্ঞায় ভারতে মুসলিমরা একটি আলাদা জাতি। সুতরাং ধর্ম বিশ্বাস সংস্কৃতি ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার জন্য তাদের আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজন।  সাম্প্রদায়িকতা এবার আস্তে আস্তে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। 


  1. লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০:

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব ঘোষণা করে। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ করার রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। 


  1. ১৯৪৬ সালে নির্বাচন

১৯৪৬ সালে নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার চূড়ান্ত বিজয় ঘটে।  এই নির্বাচনে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয় দল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু ধর্মের ভিত্তিতে অখন্ড ভারত অন্যদিকে মুসলিম লীগ মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান  প্রতিষ্ঠার জন্য  নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে । মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গুলোতে মুসলিম লীগ বিজয় লাভ করে অন্যদিকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গুলোতে কংগ্রেস বিজয় লাভ করে।  এই নির্বাচনের ফলাফলে ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।  

খ. সাম্প্রদায়িকতার গতি-প্রকৃতি:

উপনিবেশিক শাসনামলে উদ্ভূত ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতা একেক সময়ে একেক রূপ ধারণ করেছিল। পলাশী থেকে শুরু করে ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্তই দীর্ঘ সময়ে সরকারের বিভিন্ন নীতি ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করা হয়েছিল। ১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ সালের বঙ্গ ভঙ্গের পূর্ব পর্যন্ত  সাম্প্রদায়িকতা কৈশোর কাল অতিক্রম করে। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতা চরম বিকাশ লাভ করে এবং এই সময়টাকে সাম্প্রদায়িকতার ভরা যৌবনকাল বলা যায়। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা পরিণতি ও বিজয় লাভ করে এবং উভয় সম্প্রদায় ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যায়। 



গ. ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার ফলাফল


  1. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা :

সাম্প্রদায়িকতার বিকাশের যুগে ভারতে বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে 1906-07 সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে। কলকাতা ও পাবনাতে 1919-26 সালের মধ্যে বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এছাড়া ১৯২৭-৩১ সালের মধ্যে পটুয়াখালী, ঢাকা,চট্টগ্রাম নোয়াখালী প্রভৃতি অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বোপরি 1946 সালে ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহত্তম ও ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়।


  1. দ্বি-জাতি তত্ত্বের উদ্ভব : 

সাম্প্রদায়িকতার কারণেই ভারতে দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটেছে এবং এই তত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাব এবং পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে দুটি সম্প্রদায় চিরতরে আলাদা হয়ে যায়। 


  1. কলকাতা দাঙ্গা : 

মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হিসেবে চিহ্নিত করে ঐদিন সকল কাজ-কর্ম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । অপরদিকে হিন্দু জনমত পাকিস্তান বিরোধী স্লোগানকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হতে থাকে । ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ হিন্দু দোকানপাট বন্ধ রাখতে বললে হিন্দুরা মুসলিম লীগের শোভাযাত্রার পথে বাধার সৃষ্টি করে । তখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংগঠিত হয়। এ দাঙ্গায় ৪০০০ লোক মারা যায় এবং ১,০০,০০০ লোক আহত হয় । ২২ তারিখে কলকাতার পরিস্থিতি শান্ত হয়। ১৯৪৬ সালের এ দাঙ্গা অবশ্যই সাম্প্রদায়িক ছিল। এ দাঙ্গায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত আক্রমণ ও হত্যাকান্ড পরিচালনা করা হয় ।


  1. সমঝোতা ও মানবতা:

১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গা বাংলা এবং বিহারে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক হারে মুসলিম নিধন শুরু হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকার দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। মুসলিম নিধনের সংঘাতে মহাত্মা গান্ধী বিচলিত হন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেন। গান্ধীজী ঘোষণা করেন যে মুসলিমের উপর আক্রমণ হলে তিনি অনশন করবেন। উভয়ের চেষ্টায় কলকাতায় দাঙ্গা বন্ধ হয় । আবার বিভিন্ন স্থানে অনেক হিন্দু মুসলিমদেরকে আশ্রয় দিয়েছে আবার মুসলিমরা অনেক হিন্দুকে আশ্রয় দিয়েছে দাঙ্গা থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য। সুতরাং এই কঠিন দাঙ্গার সময়ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝোতা এবং হিন্দু মুসলিম উভয়ের মধ্যে কিছু কিছু মানবতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়


  1. ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব : 

ব্রিটিশ সরকার এ পর্যায়ে শেষদিকে উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।


  1. দেশত্যাগ : 

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে শেষাবধি লাভবান হয় পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলিমরা, আর উত্তর প্রদেশ এবং আংশিকভাবে মধ্য প্রদেশ ও বিহারের হিন্দুরা। উপমহাদেশের সুবৃহৎ অন্যান্য অংশের সংখ্যালঘু মানুষের জীবনে নেমে এসেছে জানমালের অনিশ্চয়তা। মুসলমানরা ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে এবং হিন্দুরা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়।


  1. নিজ দেশে পরবাসী : 

সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজ দেশে পরবাসী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।


উপসংহার :

পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নানা কারণে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ঘটে । মূলত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিপরীতমুখী অবস্থার কারণে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায় । তাছাড়া ব্রিটিশ সরকার নিজেদের শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে যে ভেদরেখা টেনে দিয়েছিল তারই ফসল হলো সাম্প্রদায়িকতা। তাই ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে পাকিস্তানে হিন্দুরা এবং ভারতে মুসলমানরা আতঙ্কে থাকত । সাম্প্রদায়িকতার বহিঃপ্রকাশ আজো ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে প্রকট আকার ধারণ করে ।




আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা


আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান


আরও পড়ুন-

বাঙ্গালি জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি


আরও পড়ুন-

বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, সীমানা ও ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহ



আরও পড়ুন-

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বিদ্যমান বৈষম্য


গ্রন্থপঞ্জি:

  1. ড.আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫-১৯৭১,  তৃতীয় সংস্করণ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৮,

  2. ড. এ কে এম শওকত আলী খান ও অন্যান্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, গ্রন্থ কুটির পাবলিকেশন, ঢাকা, ২০১৪। 

  3. https://rb.gy/ytnvtp

  4. https://rb.gy/quv63





Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.




No comments:

Post a Comment