চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-1793
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ফলাফল
ভারতীয় উপমহাদেশে শত শত বছরের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়ে সেখানে এক নতুন সমাজ ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্ব নীতি তথা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন করেন৷ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি সরকার এদেশে তাদের ক্ষমতার স্থায়ী ভীত তৈরি এবং একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করার প্রয়াস পায়৷ এই ব্যবস্থায় জমিদারকে জমির মালিক বলে স্বীকার করা হয় এবং কৃষককে বানানো হয় জমিদারের প্রজা৷ সরকার এবং কৃষক উভয়ের জন্য কল্যাণজনক বলা হলেও বাস্তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কৃষক সমাজ উপকৃত হয়নি৷ ঊনবিংশ শতকের শুরুতে বাংলার সমাজ কাঠামোতে যে পরিবর্তন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নতুন উপাদান এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ লাভ করেছিল তার সবই ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি
ক. দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা:
১৭৬৫ সালে দিওয়ানী লাভ করার পর কোম্পানি অধিক মুনাফা এবং খরচ বাচাতে নিজেরা দেওয়ানী পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নবাবের মাধ্যমে পরিচালনা করে৷ নবাব নিজামত প্রধান এবং ডেপুটি দেওয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ মূল ক্ষমতা কোম্পানির হাতে থাকায় দেশে নৈরাজ্য দেখা দেয়৷ কৃষকের উপর করের বোঝা প্রতি বছরই বাড়তে থাকে৷ ১৭৬৯-৭০ সালে অনাবৃষ্টির কারণে ফসলের হানি ঘটে। ১৭৭০ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং এতে প্রায় এক- তৃতীয়াংশ মানুষ না খেয়ে মারা যায়৷ এই দ্বৈত শাসনের চরম ব্যর্থতার কারণে 1772 সালে ইন্ডিয়ান রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস করে দৈত্ব শাসন ব্যবস্থা বাতিল করা হয়৷ ওয়ারেন হেস্টিংসকে গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করে সরাসরি দিওয়ানী এবং নিজামত পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
খ. পাঁচসনা বন্দোবস্ত:
১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক প্রবর্তিত পাঁচ সনা বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার পুরাতন জমিদারদের পতন ঘটে এবং মুনাফাখোরী, ফটকাবাজ, মহাজন, নায়েব গোমস্তারা নতুন জমিদারি লাভ করে৷ তারা উচ্চ দামে নিলাম ডেকে জমিদারি কিনে নেয়৷ কিন্তু দুর্ভিক্ষের কারণে কৃষকদের অবস্থা খারাপ থাকায় কোম্পানি নির্ধারিত খাজনা আদায়ে ব্যর্থ হয়৷ খাজনা বাকি পরে এবং পাঁচ সনা বন্দোবস্ত ব্যর্থ হলে ১৭৭৭ সালে তা বাতিল করা হয়৷ পুনরায় এক বছর মেয়াদী বন্দোবস্ত চলতে থাকে৷
গ. ভূমি রাজস্ব বিষয়ক চিন্তা-গবেষণা:
১৭৮৫ সালে পিটস ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পাস করা হয়৷ এই আইনের আওতায় লর্ড কর্নওয়ালিসকে 1786 গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়৷ তাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য -
- জনশোর,
- জেমস গ্রান্ট,
- উইলিয়াম জোন্স এবং
- জোনাথন ডানট্রান
এই চারজন বিজ্ঞ কাউন্সিলর নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাকে যত দ্রুত সম্ভব একটি স্থায়ী রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশ দেয়া হয় ৷ কর্নওয়ালিশ নিজে ভূমি বিশেষজ্ঞ ছিলেন৷ তিনি ব্রিটিশ মডেলে ভারতে ভূমি রাজস্ব পরিচালনায় উদ্যোগী হন৷ আলেকজান্ডার দাও এবং হেনরি প্রেট্টুলার ধারণা মোতাবেক কর্নওয়ালিস একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেন৷ লর্ড কর্নওয়ালিস জমিদারদেরকেই জমির মালিক বলে মনে করতেন, কিন্তু তার কাউন্সিলর জেমস গ্রান্ট কৃষককে জমির মালিক বলে মনে করতেন৷ কোর্ট অফ ডিরেক্টর কর্নওয়ালিসের পক্ষে মত দিলে তিনি কৃষকদের সাথে নয় বরং জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন৷ তবে রাজস্ব বিশেষজ্ঞ কাউন্সিলর জন শোর জমির প্রকৃত অবস্থা ও উৎপাদন ক্ষমতা না জেনে এবং জরিপ না করে প্রথমেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরোধিতা করেন৷ তিনি প্রথমে দীর্ঘমেয়াদি এবং পরে তথ্য সংগ্রহ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে মত দেন ৷ কিন্তু কর্নওয়ালিসের মতে খাজনা স্থায়ী না হলে জমিদার এবং কৃষকরা জমির উন্নতি করবে না৷
ঘ. দশ সনা বন্দোবস্ত
1786-89 তিন বছর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৯ সালে বিহারে এবং ১৭৯০ সালে বাংলায় ১০ বছর মেয়াদী বন্দোবস্ত চালু করেন৷ এই ব্যবস্থায় উল্লেখ করা হয় যে, যদি বোর্ড অফ দিরেক্টর দশসনা বন্দোবস্ত কে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মত দেন তাহলে দশসনা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
ঙ. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩:
১৭৯২ সালের শেষ দিকে কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস কর্নওয়ালিশের মতামত কে সমর্থন করে ১০ বছরের মেয়াদী বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার পক্ষে মত দিলে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২২ শে মার্চ ১০ সনা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে ঘোষণা করেন৷
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্যসমূহ/ ধারা
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারদেরকে জমির মালিক বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। জমি হস্তান্তর,ক্রয়-বিক্রয় এবং দানপত্র করা ও উত্তরাধিকারীদেরকে মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়৷
বন্দোবস্তের মাধ্যমে কৃষককে জমিদারের প্রজা হিসেবে স্বীকার করা হয়।
রাজস্ব পরিশোধের সময়কাল এবং রাজস্বের হার চিরদিনের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
তালুকদারী প্রথা বাতিল করে ছোট ছোট সকল তালুকগুলোকে স্বতন্ত্র জমিদারি হিসেবে বিবেচনা করে বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বড় বড় জমিদারিগুলোতে তাদের জমিদারী টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তালুকদারী প্রথার পুনরুত্থান ঘটে।
জমিদার কৃষককে দশ বছর মেয়াদী পাট্টা দিবে৷ এতে খাজনা,জমির পরিমাণ সবকিছু উল্লেখ থাকবে৷ অতিরিক্ত আবওয়াব বা এধরনের কোন কর আরোপ করা যাবে না।
ভূমি প্রশাসনের বাইরে জমিদারদের সকল পুলিশি তথা ফৌজদারী ক্ষমতা বাতিল করা হয়। কিন্তু ১৭৯৯ সালে জমিদারদের আন্দোলনের মুখে তাদেরকে ফৌজদারি ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রজাদের দেয়া খাজনার 90% পাবে সরকার এবং 10% পাবে জমিদার
ভূমি প্রশাসনের সাথে জড়িত এদেশীয় সকল কর্মচারীর পদ ও পদবী বাতিল করা হয়
খাজনা চিরদিনের জন্য নির্ধারিত এবং তা কখনোই পরিবর্তন করা হবে না৷
খরা, বন্যা, মহামারী বা যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও খাজনা মওকুফ করা হবে না।
ওয়ারিশ বিহীন জমিদার মৃত্যুবরণ করলে সেই জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে৷
নারী, নাবালক এবং শিশু বন্দোবস্ত অযোগ্য"
১৭৬৫ সালের পূর্বের দেয়া লা-খেরাজ বৈধ, পরেরগুলো অবৈধ। প্রমাণপত্র বিহীন যে কোন লাখেরাজ বাতিল হবে।
খাজনা পরিশোধ করতে হবে সিক্কা টাকায়।
কৃষি যন্ত্রপাতি এবং কৃষককে কোনোভাবে আটক করা যাবে না। কিন্তু ১৭৯৯ সালে ফৌজদারী ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার পর জমিদাররা কৃষকের ভিটায় ঘুঘু চড়িয়েছে।
নির্ধারিত দিনে সূর্যাস্তের পূর্বেই খাজনা পরিশোধ করতে হবে। খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে ওই দিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে।
জমিদাররা বংশানুক্রমিক ভাবে জমিদারি ভোগ করতে পারবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভারতে প্রবর্তিত একটি নতুন ব্যবস্থা৷ এই ব্যবস্থা ঠিকমতো পরিচালনা করার জন্য কতগুলো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়৷ যেমন-
বোর্ড অফ রেভিনিউ (গভর্নরের অধীনে)
কোর্ট অব ওয়ার্ডস ( পরিচালনা প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য)
জেলা কালেক্টর
এছাড়া জমিদারদের অধীনে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ছিল সেগুলো হলো-
সেরেস্তাদার
দেওয়ান
খাজাঞ্চি
মুন্সি মোহরাপ
তহশীলদার
রেকর্ড কিপার
পাটোয়ারী
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
প্রশাসনিক ব্যয়ভার কমানো
আয় নির্দিষ্ট করা
নির্দিষ্ট বাজেট প্রনয়ণ করা
ভূমিতে স্থায়ী মালিকানা তৈরি
বৃহৎ জমিদারি খন্ডন
সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করা
আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন
ভূমি ও কৃষির উন্নয়ন সাধন
ব্রিটিশ শাসনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল /প্রভাব/সুফল-কুফল/ গুরুত্ব/পরিনিতি:
ভূমি ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন
সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন
আয় সুনির্দিষ্ট হয়
কোম্পানির আজ্ঞাবহ শ্রেণীর উদ্ভব
উচ্চ হারের রাজস্ব
রায়তের দুরবস্থা বৃদ্ধি
কৃষকের উচ্ছেদ
প্রকৃত জমিদারদের পতন
মধ্যসত্বভোগীদের অত্যাচার
বৃহৎ জমিদারি খন্ডন
উদীয়মান পুজিপতিদের উত্থান
মহাজনদের শোষণ
সূর্যাস্ত আইন
মুসলিম অভিজাতদের পতন
According to Tarachand-
The settlement destroyed the old village community, changed the property relations, created new social classes and caused a social revolution in the Indian countryside
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
আরও পড়ুন-
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ।। Shah Wali Ullah
আরও পড়ুন-
নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
বক্সারের যুদ্ধ এবং নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান
আরও পড়ুন-
আকবরের ধর্মনীতিঃ দীন-ই-ইলাহী।। প্রেক্ষাপট, মূলনীতি এবং সমালোচনা
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment