Breaking

Thursday 29 December 2022

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিঃ বনিক থেকে রাজন্য হওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস


 ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি:  

বনিক থেকে রাজন্য হওয়ার সংক্ষিপ্ত  ইতিহাস

(British East India Company)



ভারতে ইউরোপিয়ানদের আগমন:

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমন এবং উত্থান সম্পর্কে আলোচনার আগে ভারতে ইউরোপীয়দের আগমন সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। রেনেসাঁ প্রসূত ইউরোপীয় জাতি ভৌগোলিক আবিষ্কারের যুগে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। তারই ধারাবাহিকতায় তারা বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচারের নিমিত্তে ভারতীয় উপমহাদেশে উপস্থিত হয়। ইউরোপীয় পাঁচটি  দেশের বণিকরা ভারতে আগমন করেছিল। 







  1. পর্তুগিজ:  

1498 সালের 27 শে মে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা সর্বপ্রথম ভারতে আসেন। ভাস্কোদাগামা এর আগে 1487 সালে বার্থোলোমিউ দিয়াজ নামক এক জন নাবিক উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে আসার পথের সন্ধান দেন। সেই পথ ধরেই ভাস্কোদাগামা 1498 সালে দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় কালিকটেেএসে উপস্থিত হয়। আর পর্তুগিজরা বাংলায় আসে 1516 সালে। বাণিজ্যের পাশাপাশি পর্তুগিজরা দাস ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।  ভারতে পর্তুগীজদের ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত। 


  1. ওলন্দাজ বা ডাচ:

হল্যান্ডের নাগরিকদেরকে পর্তুগিজ ভাষায় ওলন্দাজ বলা হয়। জাতীয়ভাবে তারা ডাচ নামে পরিচিত। ওলন্দাজরা সর্বপ্রথম ভারতে আসে 1602 সালে। তাদের কোম্পানির নাম ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । এটি 1602 সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। 


  1. বৃটিশ তথা ইংরেজ:

ইংরেজরা সর্বপ্রথম ভারতে আসে 1608 সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে। তাদের কোম্পানির নাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি 1600 সালের 31শে ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে ভারতে বাণিজ্য করতে আসে। সাধারণত ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে তারা পরিচিতি পেলেও তাদের  কোম্পানির অফিসিয়াল নাম ছিল ‘The Governor and company of Marchant of London Trading into the East Indies’ 


  1. দিনেমার তথা ডেনিস:

ডেনমার্কের নাগরিকরা ডেনিস নামে পরিচিত পর্তুগিজ ভাষায় এরা ভারতে দিনেমার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দিনেমার তথা ডেনিসরা ভারতে আসে 1620 সালে। তাদের কোম্পানির নাম ডেনিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। 


  1. ফরাসি তথা ফ্রান্স: 

ভারতের সর্বশেষ আগমন করে ফরাসিরা। ফরাসি বণিকরা 1667 সালে সর্বপ্রথম ভারতে আগমন করে। তারা বাংলায় আসে 1674 সালে। তাদের কোম্পানির নাম ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এটি 1664 সালে গঠিত হয়। 



ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

British East India Company



ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারতে সর্বপ্রথম পর্তুগীজরা আগমন করলেও তারা পরবর্তীতে আগত ব্রিটিশদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাছাড়া পর্তুগীজদের দাসব্যবসা এবং স্থানীয় মানুষদের উপর নিপীড়ন নির্যাতনের কারণে তারা ঘৃণিত ছিল।  পরবর্তীতে আগত ওলন্দাজ, দিনেমার এবং ফরাসিদের সাথে ও ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়।  ভারতে ব্রিটিশরা বাণিজ্যিক শক্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক শক্তি দখল করতে সক্ষম হয়। এক্ষণে আমরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে একটি বেনিয়া গোষ্ঠী থেকে রাজ শক্তিতে পরিণত হল সে বিষয়ে আলোচনা করব। 



ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক অগ্রগতি: 

আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে ভারতে ব্রিটিশরা আগমন করেছে 1608 সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 16 সালের 31শে ডিসেম্বর। অতঃপর বাণিজ্যের অনুমতি চেয়ে কোম্পানির প্রতিনিধি কেপটেন হকিং ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস এর চিঠি নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে আগমন করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। 1612/13 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গুজরাটের সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে।


1633 সালে তারা নামমাত্র বাংলায় আসে এবং সীমিত পরিসরে বাণিজ্য শুরু করে। 1651 সালে তারা সর্বপ্রথম বাংলার হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। বাণিজ্যের পাশাপাশি বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি দেয়া, স্থানীয় কৃষকদের উপরে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। 1686-90 সালের মধ্যে সংঘটিত এই যুদ্ধে কোম্পানি পরাজিত হয় এবং তারা মুচলেকা ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি প্রার্থনা করলে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাদেরকে আবারও বাণিজ্য করার অনুমতি দেন এবং বাৎসরিক এককালিন 3000 টাকা প্রদানের বিনিময় বাণিজ্যসহ সুতানটিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। 


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমিদারি লাভ:

ক্ষতিপূরণ ও মুচলেকা দিয়ে বাণিজ্য করা ও বসতি স্থাপন করার অনুমতি পাওয়ার পর 1690 সালে কোম্পানি  সুতানটিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আশে পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের উপর স্থায়ী স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তাদের ‍উদ্দেশ্য ছিল একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা এবং একটি সুরক্ষিত বসতি স্থাপন করা। 


1697 সালে কোম্পানি সুবেদার আজিমুশ্বান কে 16000 টাকা বার্ষিক নজরানা প্রদান করে কলকাতা সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদারী সত্ব প্রার্থনা করে। 1698 সালে নবাব কে বার্ষিক 1194 টাকা 14 আনা 4 পয়সা জমা দেয়ার শর্তে কোম্পানিকে উক্ত তিনটি গ্রামের জমিদারি প্রদান করা হয়। জমিদারী লাভের মাধ্যমে এই বণিক গোষ্ঠী ভারতের বৈধ শাসক শ্রেণীর অংশে পরিণত হয়। কলকাতা সুতানুটি গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম ঘিরে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে । কলকাতায় তারা বাজার প্রতিষ্ঠা করে। অচিরেই কলকাতা দেশের অন্যতম বড় ক্রয়-বিক্রয় ও আমদানি রপ্তানির কেন্দ্রে পরিণত হয়। 



ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ:

এদিকে 1695-96 সালের দিকে মেদিনীপুরের জমিদার সোভা সিংহ ও তার সঙ্গী রহিম খান বিদ্রোহ করলে আইনশৃংখলার চরম অবনতি ঘটে। ফলে বিদেশি বণিকরা নিজস্ব বাণিজ্য সামগ্রী রক্ষাসহ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি প্রার্থনা করলে সুবেদার ইব্রাহিম খান তা মঞ্জুর করেন। অর্থাৎ যুদ্ধকালীন সময়ে যাতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য নবাব কর্তৃক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলেও তারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার গ্রহণের জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমতি পার্থনা করে। অনুমতি পাওয়ার পর কোম্পানি 1697 সালে সুতানটিতে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজা নামে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে। 


বিদ্রোহ বিশৃংখলার সুযোগে নিরাপত্তার অজুহাতে দুর্গ নির্মাণ করলেও শান্তির সময় তারা কখনোই আর এই দুর্গ ধ্বংস করে নি। বরং নদীপথে ইউরোপীয় সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আনয়নের মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে তারা অত্যাধুনিক সামরিক দুর্গে পরিণত করে। 


সম্রাট ফররুখ শিয়ারের ফরমান 1717:

সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল আমলের পতনের যুগ শুরু হয়। এসময় মোঘল সিংহাসন কোনো যোগ্য উত্তরাধিকারী পায়নি। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুঘলরা বিভক্ত হয়ে পড়ে।  দীর্ঘদিন অসুস্থ সম্রাট ফররুখ শিয়ারকে ডাক্তার উইলিয়াম হেমিলটন সুস্থ করে তুললে 1717 সালে সম্রাট কোম্পানিকে ব্যাপক সুবিধা সম্বলিত এক রাজকীয় ফরমান প্রদান করেন। এই ফরমানকে  বাংলায় ইংরেজ বাণিজ্যের মেঘনাকার্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফরমানে দেশীয় এবং অন্যান্য বিদেশী বণিকদের চেয়ে ব্রিটিশদেরকে ব্যাপক সুবিধা প্রদান করা হয় যা নিম্নরূপ- 


  1. বার্ষিক 3000 টাকা পেশকাসের  বিনিময়ে কোম্পানি অবাধে সর্বত্র বাণিজ্য করতে পারবে।

  2. কোম্পানির যে কোনো জায়গায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করতে পারবে। 

  3. কোম্পানির মালামাল হারিয়ে গেলে বা  চুরি হলে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে। 

  4. তাদের ক্রয়কৃত গ্রামগুলোতে তাদের অধিকার থাকবে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো ইজারা নেয়ার ক্ষেত্রে সুবেদার সম্মতি দিবেন।

  5. কোম্পনির নিজস্ব জাহাজ অথবা ভাড়া করা জাহাজকে কোথাও বাধা দেওয়া বা উত্যক্ত করা যাবে না।

  6. কোম্পানির মালামাল কোন কাস্টম চৌকিতে তল্লাশি করা যাবে না।

  7. মুর্শিদাবাদ টাকশাল থেকে কোম্পানি তাদের সোনা রুপা দিয়ে মুদ্রা তৈরি করতে পারবে। ইত্যাদি। 


কোম্পানি-নবাব বাণিজ্য শুল্ক দ্বন্দ্ব: 


এ সমস্ত সুবিধা আদায় ছিল কোম্পানির জন্য বড় ধরনের সাফল্য। কিন্তু এই চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্য করার যে অধিকার ও সুবিধা পায়  তাতে দেশীয় ও বিদেশী অন্যান্য দেশের বনিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা কোম্পানির তিন হাজার টাকার দস্তকের অপব্যবহার করে নিজেরা ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছিল বিনাশুল্কে বানিজ্য করার অধিকার বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলি খানের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না । মুর্শিদকুলি খান শুধু মাত্র 3000 টাকার বিনিময় কোম্পানিকে বাণিজ্য করার অনুমতি দিতে রাজি ছিলেন কিন্তু এর অপব্যবহার করে কোম্পানির কর্মচারীদেরকে বিনাশুল্কে ব্যাক্তিগত বাণিজ্য করতে দিতে রাজি ছিলেন না। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে কোম্পানির সাথে মুর্শিদকুলি খানের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মুর্শিদকুলি খাঁন ও আলীবর্দী খানের সাথে কোম্পানি সুবিধা করতে পারেনি। 


অনুকূল নবাব বসানোর চক্রান্ত:

মোগল সম্রাটের কাছ থেকে রাজকীয় ফরমান পেলেও বাংলার নবাব তাদের এই একচেটিয়া বাণিজ্য করতে না দেওয়ার কারণে এবার কোম্পানি ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করে। বাংলার মসনদে তারা এমন একজন নবাব কে দেখতে চায় যিনি মুঘল সম্রাটের মতো তাদের অনুকূলে কাজ করবেন। যাতে করে কোম্পানি বিনাশুল্কে একচেটিয়া বাণিজ্য করতে পারে। এই চক্রান্তটি বাস্তবায়ন করার জন্য তারা নবাব বিরোধীদের খুঁজতে থাকে যাদের সাথে আঁতাত করা সম্ভব।  মুর্শিদকুলি খান ও আলীবর্দী খানের সময় তারা তেমন সুবিধা করতে না পারলেও সিরাজউদ্দৌলার সময়ে তারা কার্যকর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু করে।  ঘষেটি বেগম, শওকত জং, মীর জাফর আলী খাঁ,জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ এসমস্ত দুষ্কৃতিকারীদের মাধ্যমে তারা সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে। 


ক্লাইভ-মীরজাফর গোপন চুক্তি

অতঃপর এসব ইতিহাস কমবেশি আমাদের সকলেরই জানা। এক্ষেত্রে নবাবের  হিন্দু কর্মচারীরা ছিল ইংরেজদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি। কিন্তু তাদের যে কোনো একজনকে বাছাই করা হয়নি এই কারণে যে তাৎক্ষণিকভাবে এসময় কোন হিন্দুকে নবাবী মসনদে বসালে তা বাংলার জনগণ মেনে নিবে না। সেজন্যই কোম্পানি সিরাজউদ্দৌলার অত্যন্ত শক্তিশালী ব্যক্তি মুসলিম বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর আলী খানকে নির্বাচন করে। সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটলে পরবর্তীতে মীরজাফরকে নবাব বানানো হবে এইরকম প্রলোভনে মীরজাফর এর সাথে কোম্পানির ১টি গোপন চুক্তি হয়। আর সেই ষড়যন্ত্রের মঞ্চায়ন হয় 1757 সালের 23শে জুন পলাশী প্রান্তরে। 



পলাশীর যুদ্ধ 1757: 


ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অতঃপর 1757 সালের 23 শে জুন পলাশীর প্রান্তরে অনুষ্ঠেয় পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফরের বাহিনীর নিষ্ক্রিয় থাকে। পরবর্তী দিনে যুদ্ধ করা হবে এই মর্মে মীরজাফর নবাবের নিকট যুদ্ধ বন্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করে। অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রধান সেনাপতির কথা শুনতে হয়। আর এখানেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়। মীর জাফরের বাহিনী নিষ্ক্রিয় হলে অন্য দিক থেকে রবার্ট ক্লাইভ নবাবের বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালালে নবাব পরাজিত হন। মীর মদন মোহন লাল আপ্রান চেষ্টা করেও প্রাণ বিসর্জন দেন। পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। অন্যদিকে কোম্পানি বাংলার মসনদ দখলের প্রথম ধাপ অতিক্রম করে। 


বক্সারের যুদ্ধ 1764: 

বক্সারের যুদ্ধ ছিল  কোম্পানির ক্ষমতা গ্রহণের জন্য পলাশী অপেক্ষা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ। পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রথম ধাপ অতিক্রম করলেও তখনও চূড়ান্ত ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না।  এদিকে মীর কাসিম আলি খান বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকেন । ফলশ্রুতিতে 1764 সালে কোম্পানি বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম কে পরাজিত করে বাংলার চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। 


কোম্পানির দেওয়ানি লাভ 1765: 

পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করলেও তখনও অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না। কারণ মুঘল আমলের প্রাদেশিক ব্যবস্থায় অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা তথা রাজস্ব নির্ধারণ ও উত্তোলনের ক্ষমতা ছিল দিওয়ানের হাতে। এই পদটি তখনও কোম্পানি দখল করতে পারেনি। আর এ পদবী দেওয়ার ক্ষমতা ছিল মুঘল সম্রাটের হাতে। তঃপর কোম্পানি উপহার-উপঢৌকন নিয়ে মুঘল সম্রাটের কাছে উপস্থিত হয়। মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক 26 লক্ষ টাকা, এছাড়া উপহার হিসেবে এলাহাবাদ ও কারা জেলার রাজস্ব প্রদান এবং বাংলার নিজামত পরিচালনা করার জন্য বাংলার নবাব কে 53 লক্ষ 86 হাজার 131 টাকা 9 আনা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলার দেওয়ানি তথা আর্থিক ক্ষমতা প্রার্থনা করে। 


একেতো সম্রাট ছিলেন বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত শক্তি, দ্বিতীয়তঃ সম্রাটের অর্থাভাব ছিল প্রকট, বিজয়ী শক্তি হিসেবে কোম্পানি যে দিল্লি দখল করেনি সেটাই তো অনেক কিছু। এছাড়া কোম্পানি অনেক উপহার-উপঢৌকন নিয়ে এসেছে, এলাহাবাদ ও কারা জেলার রাজস্ব  উপহার হিসেবে সম্রাটকে ছেড়ে দিয়েছে এবং বাৎসরিক 26 লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় অর্থক্লিষ্ট সম্রাট কোম্পানির এ প্রস্তাব মেনে নিয়ে 1765 সালের 12 আগস্ট এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিকে বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী হস্তান্তর করেন। মুঘল সম্রাট কর্তৃক দিওয়ানি প্রদানের মাধ্যমে অবৈধ দখলদার বেনিয়া গোষ্ঠী এদেশের বৈধ শাসকে পরিণত হয়।


পলাশীর যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে কোম্পানি রাজনৈতিক ভিত্তি রচনা করে। আর বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে কোম্পানির চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। অতঃপর দিওয়ানি লাভের মাধ্যমে কোম্পানি এ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গতা পায়। এভাবেই ব্রিটিশ এই বেনিয়া গোষ্ঠী বণিক থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়।



পরিশেষে আমরা দেখতে পাই যে কোম্পানির ক্ষমতা গ্রহণ ছিল একটি ধারাবাহিক অগ্রগতিমূলক প্রক্রিয়া। প্রথমে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। বসতি স্থাপনের নামে কলকাতা সুতানটি ও গোবিন্দপুরে তারা স্থায়ী আবাস  স্থাপন করেছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে তারা এখানে দুর্ভেদ্য সামরিক দুর্গ নির্মাণ করেছে। ফররুখশিয়ারকে বশীভূত করে একচেটিয়া বাণিজ্য করার ফরমান নিয়েছে। অতঃপর তারা মুর্শিদকুলি খান ও আলীবর্দী খানের সাথে না পেরে সিরাজউদ্দৌলার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মসনদ দখল করেছে। পলাশীর যুদ্ধে আংশিক, বক্সারের যুদ্ধের চূড়ান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে তারা বাংলার চূড়ান্ত ক্ষমতা দখল করেছে। 




আরও পড়ুন-


আরও পড়ুন-



আরও পড়ুন-


আরও পড়ুন-

বক্সারের যুদ্ধ  এবং  নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান 


আরও পড়ুন-

আকবরের ধর্মনীতিঃ দীন-ই-ইলাহী।।   প্রেক্ষাপট, মূলনীতি এবং সমালোচনা


Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS General Education

Lecturer

Department of Islamic History & Culture

Chandpur Govt. College, Chandpur.





No comments:

Post a Comment