ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতি
ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে মুঘলদের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, যা ছিল মক্তব কেন্দ্রিক এবং ব্যক্তি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ। মুঘল আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা কখনোই উচ্চশিক্ষা ছিল না। এসব শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মের আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশরা এদেশের ক্ষমতা দখলের পর প্রায় ৫০ বছর যাবৎ মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া ভারতবাসী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল। প্রথম দিকে কোম্পানি সরকার এদেশের মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে তারা একান্ত নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে, যাতে কৌশলে এদেশের মুসলমানদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়। বৈষম্যমূলক এই শিক্ষা নীতি হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করলেও মুসলিমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। যার কারণে মুসলিমরা শিক্ষা-দীক্ষায় প্রায় একশত বছর পিছিয়ে পড়ে। বস্তুত মুসলমানদের পশ্চাদপদতার জন্য তারা নিজেরা যতটুকু দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল কোম্পানির শিক্ষানীতি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতি:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল মূলত একটি ব্যবসায়ীক গোষ্ঠী। বাংলার শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে তারা ক্ষমতা দখল করে। এ দেশবাসীকে শিক্ষিত প্রজা হিসেবে তারা দেখতে চায়নি। ব্রিটিশরা প্রথম থেকে এদেশের মানুষকে শিক্ষিত করতে চাইনি। কারণ-
ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতি ছিল তাদের মূল লক্ষ্য;
শিক্ষা বিস্তার করতে হলে খরচ বৃদ্ধি পাবে;
দেশবাসীকে শিক্ষিত করলে এরা সচেতন হয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। যেমন অভিজ্ঞতা তারা আমেরিকার নিকট থেকে লাভ করেছিল।
এ বিষয়ে পার্লামেন্টে তুমুল বিতর্কের পর অন্যতম পার্লামেন্ট সদস্য মিস্টার র্যান্ডেল জ্যাকসন মন্তব্য করেন যে- `আমাদের শিক্ষাদর্শ বিস্তার করে আমেরিকায় আমাদের কলোনি হারিয়েছি ভারতে এর পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নাই’
এতদ সত্বেও ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কারণে এবং নিজেদের একান্ত প্রয়োজনে তারা শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছিল।
ধর্ম প্রচার এবং বৃটিশ মিশনারীদের কার্যক্রম:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে বাণিজ্যের পাশাপাশি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য ছিল। বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে খ্রিস্টান মিশনারীরা ভারতে আগমন করে। ১৬৫৯ সালে কোম্পানির সরকার বাণিজ্যের পাশাপাশি এখানে ধর্মপ্রচারের আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৬৯৮ সালে অন্য একটি আদেশে কোম্পানি সরকার ভারতে মিশনারিদের আগমনের ব্যবস্থা করে। প্রতিটি জাহাজে একজন করে ধর্মযাজক রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সরকার ধর্ম প্রচারের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকে । এ সমস্ত মিশনারিদের উদ্যোগে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। যেমন-
S.P.C.K : Society for Promotion of Christian Knowledge
S.P.G : Society for promotion of Gospel
শ্রীরামপুর মিশন এর কার্যক্রম:
এসময় ব্রিটিশ মিশনারীদের পাশাপাশি ইউরোপীয় অন্যান্য দেশের মিশনারিরা ও একই ভূমিকা গ্রহণ করে। যেমন দিনেমার মিশনারি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর মিশন। ব্রিটিশদের অনুগামী হয়ে ১৭৯৩ সাল থেকে তারা ভারতে শিক্ষা প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে। ১৮০০ সালে তারা কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপন করে। এই ছাপাখানা থেকে পরের বছর বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট এর বাংলা অনুবাদ করে এবং ভারতের প্রায় ৩১টি ভাষায় সেটার অনুবাদ করা হয়। শ্রীরামপুর মিশন কলকাতার উপকণ্ঠে বালক বালিকাদের জন্য অনেকগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠা করে।
ডেনিশ ও ব্রিটিশ মিশনারিদের মত পর্তুগিজ মিশনারি এবং ফরাসি মিশনারিরাও একইভাবে বিভিন্ন ছাপাখানা স্থাপন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
বিশপতন্ত্র চালু:
১৮১৩ সালের সনদ আইনে নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় পাশ্চাত্যবাদী পার্লামেন্ট সদস্যরা দাবি করেন যে ভারতবর্ষে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে খ্রিস্টান ধর্মের নীতি-রীতি শিক্ষা দেওয়া হবে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা এবং এই শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব মিশনারীদের উপর অর্পণ করাই হবে যুক্তিযুক্ত। সরকারকে এজন্য অর্থ সাহায্য দিতে হবে। এই আইনের মাধ্যমে 1813 সালে বিশপতন্ত্র চালুর অনুমতি দেয়া হয়। কলকাতায় বিশপের অফিস খোলা হয় এবং বিপুল সংখ্যক মিশনারি ভারতে আগমন করে নতুন উদ্যোগে শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করে । তারা বেশ কিছু সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে যেমন-
জেনারেল ব্যপ্টিস্ট মিশন সোসাইটি
লন্ডন মিশনারি সোসাইটি
চার্চ মিশনারি সোসাইটি
তারা কলকাতা বোম্বে ও মাদ্রাজের বিভিন্ন স্থানে বহু স্কুল ও কলেজ তারা প্রতিষ্ঠা করে। এ সময় নারী শিক্ষার বিস্তারেও তারা বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। এসবই ছিল তাদের ধর্মীয় উদ্দেশ্যে, এদেশের মানুষকে শিক্ষিত করার মত মহৎ উদ্দেশ্য তাদের ছিল না।
সরকারি উদ্যোগে শিক্ষানীতি প্রণয়ন
একান্তই নিজেদের প্রয়োজনে:
ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশীয় বিচার ব্যবস্থায় ব্রিটিশ আইন কানুন চালু করা হয়। হলে এদেশীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক কারণেই কোম্পানি উদার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে। এদেশীয়দের ভাষা জানা, এদেশের মধ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিরোধ মীমাংসা করার জন্য কোম্পানি এদেশীয় আইন কানুন সম্বন্ধে শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে এদেশীয়দের সন্তুষ্টি বিধানের প্রবণতা কোম্পানির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় ধর্মভিরু শিক্ষা দরদী মনীষীদের চাপে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮১ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৯১ সালে বেনারস কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ভারতীয় অতীত, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি সম্পর্কে গবেষণা ও পুনর্বসন করার উদ্দেশ্যে পন্ডিত উইলিয়াম জোন্স এর উদ্যোগে ১৭৮৪ সালে রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
রক্ষণশীল শিক্ষানীতি:
এসময় সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি শ্রেণিকে শিক্ষিত করা যারা তাদের অনুগত। যেহেতু তারা মুসলিমদের থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে সেহেতু মুসলিমদেরকে এ সমস্ত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বাইরে রাখার রাখা হয় । কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা খোলা হয়েছিল তৎকালীন আলেম-ওলামাদের চাপে এবং মুসলিমদের মাঝে নিছক কিছু ধর্মীয় শিক্ষা চালু রাখার জন্য। এর শিক্ষা কারিকুলাম খুবই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। বাইরের শিক্ষা, সামাজিক ও প্রশাসনিক জ্ঞান সম্পর্কে মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিক্ষার্থী ছাড়া তেমন কেউ উন্নতি লাভ করতে পারেনি। যদিও পরবর্তীতে পরিস্থিতির কারণে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষা চালু করা হয়েছিল।
একমাত্র কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা মুসলমানরা কোন উপকৃত হয় নাই। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হিন্দুরাই শিক্ষার দিক থেকে তাদের অবস্থার উন্নতি করেছে।
নিম্নমুখী পরিস্রাবণ নীতি:
এই নীতির মাধ্যমে তারা হিন্দু সমাজের উচুস্তরের নির্বাচিত একটি শ্রেণীকে শিক্ষিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এদের মধ্যে ছিল উদীয়মান বণিক শ্রেণি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং কলকাতার অভিজাতক শ্রেণি। এদের জন্য এই ব্যবস্থাটা একচেটিয়া থাকবে। শুধু এই উচু শ্রেণিকে শিক্ষিত করলে শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনে এরা নিজেরাই তাদের নিম্ন শ্রেণির লোকদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে। এতে কোম্পানির টাকা খরচ কমে যাবে। এর মাধ্যমে এমন একটি শ্রেণীর তৈরি হবে যা তারা চায়।
এই নীতির আওতায়-
বেনারস কলেজ
হুগলি কলেজ
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ
দ্য ক্যালকাটা হাই স্কুল
সংস্কৃত কলেজ
ভার্নীকুলার একাডেমি
অ্যাংলো হিন্দু স্কুল
হিন্দু কলেজ
ইত্যাদি সহ বেশ কিছু স্কুল-কলেজ স্থাপিত হয়। আর এ সমস্তস্কুল কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয় চার্চ কিংবা মন্দিরের কেন্দ্রিক। যাতে মুসলমানদের যাওয়ার কোন পরিবেশ ছিল না।
এগুলো ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কার্যক্রম। একইভাবে কোম্পানির মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি এবং বোম্বে প্রেসিডেন্সি নানাবিধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে।
শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান
১৮২৩ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের জন্য জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন নামক একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং বার্ষিক বরাদ্দকৃত এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার দায়িত্ব এই কমিটিকে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে লর্ড মেকলে এই কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন । ১৮৪২ সালে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন এর পরিবর্তে ‘কাউন্সিল অফ এডুকেশন’ গঠন করা হয়। কাউন্সিল ১৮৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করে।
শিক্ষা খাতে বরাদ্দ
কোম্পানির ১৮১৩ সালের সনদ আইনে সর্বপ্রথম শিক্ষার খাতে এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যদিও গোটা ভারতবাসীর শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা খুবই অপ্রতুল ছিল কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে নিয়ে বিতর্ক থাকায় সেই টাকা খরচ করা সম্ভব হয়নি। এ সময় পাশ্চাত্যবাদী এবং প্রাচ্যবাদী দুটি গ্রুপের উদ্ভব ঘটে। একটি পক্ষ সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চায়, অন্য পক্ষ ভারতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি অবলম্বন করে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে চায়।
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি:
দীর্ঘ বিতর্কের পর সরকার ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। ১৮২৯ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ইংরেজি বিভাগ খোলা হয়। সরকার ঘোষণা করে যে যারা ইংরেজি শিখবে তাদেরকে বৃত্তি দেয়া হবে। এতে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার দার উন্মোচিত হয়। এ সময় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এর শিক্ষা সচিব ছিলেন লর্ড মেকলে। তিনি ছিলেন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের উগ্র সমর্থক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদী দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে তিনি ভারতে পাশ্চাত্যশিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে ১৮৩৫ খ্রিঃ (২ ফেব্রুয়ারি) লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে একটি প্রস্তাব দেন যা 'মেকলে মিনিটস' নামে পরিচিত। মেকলে তাঁর প্রস্তাবে বলেন যে- প্রাচ্যের শিক্ষা অবৈজ্ঞানিক, চেতনাহীন এবং পাশ্চাত্যের তুলনায় নিকৃষ্ট। প্রাচ্যের সভ্যতা দুর্নীতিগ্রস্থ ও অপবিত্র। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিত।
কোম্পানি শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য:
উইলিয়াম বেন্টিং এর শিক্ষা সচিব লর্ড মেকলে এর বক্তব্যে কোম্পানি শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য প্রকাশ পায় । শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ার শর্তে তিনি শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করেন। কোম্পানির শিক্ষানীতি নির্ধারণে লর্ড মেকলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। লর্ড মেকলের পরামর্শ মত ১৮৩৫ সালে সরকার এক আদেশ জারি করে যে- ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইংরেজি জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার সাধনের জন্যই সরকারি অর্থ ব্যতীত হবে। কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এ শিক্ষানীতিকে গ্রহণ করে। ১৮৩৭ সালে অফিস আদালতে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে সর্বক্ষেত্রে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করা হয়। লর্ড মেকলে তার বক্তব্যে বলেছিলেন-
‘ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে এ দেশে এমন একটি শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে যারা ভারতে ব্রিটিশ শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এরা রক্ত মাংসের ধরনে এবং দৈহিক রঙে ভারতীয় হবেন বটে, রুচি, মতামত, নীতিবোধ ও বুদ্ধির দিক থেকে হবেন খাঁটি ইংরেজ। ’
হার্ডিঞ্জের ঘোষণা :
1844 খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরিতে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে । এই ঘোষণার ফলে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং বাঙালি সমাজে ধীরে ধীরে ইংরেজি শিক্ষিত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি আত্মপ্রকাশ করে।
মেডিকেল কলেজ ও জেলা স্কুল স্থাপন:
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে ঘোষণা করার পর ১৮৩৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৪৪ সালে বোর্ড অফ রেভিনিউ এর অধীনে প্রতিটি জেলায় একটি করে স্কুল স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এখান থেকে জেলা স্কুলের উৎপত্তি। এ সময় সরকারি এবং বেসরকারি উভয় উদ্যোগে স্কুল স্থাপিত হতে থাকে। ১৮৪৯ সালে কলকাতা মহিলা কলেজ খোলা হয়।
চার্লস উডের এডুকেশন ডেসপাচ- 1854
১৮৫৪ সালে চার্লস উড এর নেতৃত্বে আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় । শিক্ষা ক্ষেত্রে চার্লস উডের সুপারিশ ভারতের শিক্ষার ক্ষেত্রে ম্যাগনাকার্টা হিসেবে বিবেচিত। চার্লস উডের সুপারিশগুলোর মাধ্যমে ভারতে শিক্ষার বিধিবদ্ধ একটি কাঠামো গড়ে ওঠে । চার্লস উড যে সমস্ত সুপারিশ করেন সেগুলো হল-
শিক্ষার জন্য প্রতিটি প্রদেশে আলাদা শিক্ষা বিভাগ থাকবে;
উচ্চ শিক্ষার জন্য বোম্বে কলকাতা ও মাদ্রাজে ইংল্যান্ডের মত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে;
উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হবে ইংরেজি;
নিম্ন শিক্ষার জন্য বাংলা মাধ্যম থাকবে ;
শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে;
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকার সহায়তা দিতে হবে;
সরকারের পক্ষ থেকে গরিবের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে;
ব্যাপক হারে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে;
নারী শিক্ষার প্রসারে উৎসাহী হতে হবে;
মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
চার্লস উডের এ সমস্ত সুপারিশগুলোকে ভারতের শিক্ষার ক্ষেত্রে ম্যাগনাকার্টা বলা হলেও এ সমস্ত সুপারিশের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয় নাই।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতির ফলাফল /প্রভাব
হিন্দুদের উপর প্রভাব:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতি কে হিন্দুরা সাদরে গ্রহণ করেছিল। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রণীত শিক্ষানীতি এর মাধ্যমে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিল এবং শিক্ষা দীক্ষায় তারা মুসলিমদের চেয়ে প্রায় ১০০ বছর এগিয়ে যায় এবং সর্বক্ষেত্রে মুসলিমদের উপরে কর্তৃত্ব করতে শুরু করে। সরকার প্রনীত শিক্ষানীতির কোন কিছুই তাদের ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল না। আর যেহেতু কোম্পানি সরকার হিন্দুদেরকে তাদের কাছে টেনে নিয়েছিল সেতু তাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করেই তারা শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করেছে।
মুসলিমদের উপর প্রভাব:
মুসলিমদের উপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রণীত শিক্ষানীতির প্রধান ফলাফল বা প্রভাব হল এর কারণে মুসলিমরা শিক্ষা-দীক্ষায় প্রায় একশত বছর পিছিয়ে পড়েছিল। মুসলমানগন তাদের প্রণীত শিক্ষা নীতি কে গ্রহণ করতে পারেনি।
সরকারি চাকরিতে পশ্চাদপদতা:
এই শিক্ষানীতির প্রতি অনীহার কারণে মুসলিমরা সরকারি চাকরিতে বহুলাংশে পিছিয়ে পড়ে যেহেতু তারা শিক্ষা গ্রহণ করে নাই সেহেতু সরকারি চাকরিতে তাদের অংশগ্রহণটা ছিল অসম্ভব। ১৮৪৪ সালে যখন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয় তখন ইংরেজি শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলিমরা হিন্দুদের সাথে টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। সরকারি চাকরি সহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলিমরা পিছিয়ে পড়ে।
According to M. Abdur Rahim
The Muslims failed to draw the benefit of the education system introduced by the British rules on account of its serious limitation. (The Muslim Society and Politics in Bengal, first edition page-135)
মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ
তাদের প্রণীত শিক্ষা নীতি গ্রহণ না করা এবং মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল যেমন
ঐতিহ্য পরিপন্থী শিক্ষা:
কোম্পানি কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতি মুসলমানদের ধর্মীয় আদর্শ ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী ছিল তাই এটা তারা গ্রহণ করতে পারেনি।
বৈষয়িক শিক্ষা:
এতকাল যাবত মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। আর কোম্পানির নীতির পুরোটাই ছিল বৈষয়িক। তাই মুসলমানরা এটা গ্রহণ করতে পারেনি।
দূরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান:
নিম্নমুখী পরিস্রাবন নীতির মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা নগরকেন্দ্রিক এবং জেলা শহরে বা অভিজাত এলাকায় স্থাপিত হয়েছে। অসচ্ছল মুসলমানদের পক্ষে এতদূর পাড়ি দিয়ে পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল না।
ব্যয়বহুলতা:
এই শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ব্যয়বহুল। পতনউন্মুখ মুসলিম শিক্ষার্থীদের এ শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নেওয়ার সুযোগ ছিল না। ডঃ মুহাম্মদ আব্দুর রহিম বলেন-
ছাত্রদের নিকট থেকে কড়াকড়ি ভাবে বেতন আদায় করা হতো। পাঠ্যপুস্তক ব্যয়সাধ্য ছিল, আর্থিক অসংগতির কারণে মুসলমান ছাত্রদের পক্ষে বিদ্যালয়ে পড়ার খরচ বহন করা কঠিন ছিল।
মন্দির বা চার্চ কেন্দ্রিক হওয়া:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মন্দির বা চার্চ কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছিল। বিদ্যালয়ে ঢোকার পূর্বেই মন্দির বা চার্চে উপাসনা দিয়ে যেতে হতো। এই অবস্থায় সেখানে মুসলমানদের যাওয়ার কোন উপায় ছিল না।
আপত্তিকর পাঠ্য তালিকা:
স্কুলের পাঠ্য তালিকায় যে সকল বিষয়বস্তু ছিল তা মুসলমানদের জন্য ছিল আপত্তিকর। স্কুলে মনসামঙ্গল কাব্য, কীর্তন লীলা, করুণানিধন বিলাস, বঙ্গভক্তি, আনন্দ মঙ্গল, সুর সরস্বতী, শিব গঙ্গা, পদাঙ্কদূত, গীতগোবিন্দ, পদাবলী ইত্যাদি বাধ্যতামূলক ছিল। এছাড়া পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য ছিল। এগুলো পড়লে মুসলমানরা ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কায় ছিল।
লাখেরাজ বাজেয়াপ্তকরণ:
লাখেরাজ বা নিষ্কর আয়ের ভূমিতে মুসলমানদের কিছু নিজস্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলতো। কিন্তু কোম্পানি ভুমিতে পুনঃ রাজস্ব প্রবর্তনের কারণে তাদের লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। এত করে মুসলিমদের শিক্ষার জন্য আর কোন উৎসই অবশিষ্ট থাকেনি।
সামাজিক অবমূল্যায়ন:
কিছু কিছু মুসলমান শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণ করার মত সামর্থ্য ছিল, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ এবং অবমূল্যায়ন করা হতো। এতে করে ঐসব প্রতিষ্ঠানে মুসলিম সন্তানেরা না যাওয়াই ভালো মনে করত।
এ বিষয়ে উইলিয়াম হান্টার এর বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যোগ্য তিনি বলেন-
কোম্পানির ক্ষমতা গ্রহণের ১০০ বছর পূর্বে মুসলিম সমাজে গরিব ও অশিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া পাওয়া ছিল অসম্ভব। আর কোম্পানির ক্ষমতায় আসার ১০০ বছর পর মুসলিম সমাজে ধনী লোক খুঁজে পাওয়া একেবারেই অসম্ভ ‘।
বস্তুত এই সময়ে একটি জাতি হিসেবে মুসলমানদের টিকে থাকা যখন ছিল কঠিন, তখন শিক্ষা-দীক্ষায় তারা পিছিয়ে পড়বে এটাই ছিল স্বাভাবিক। প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম বলেন বাঙালি সমাজের জন্য কোম্পানির শাসন ছিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। বাংলার মুসলিমরা কিভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছিল সেই ইতিহাস এখনো অলিখিত।
কোম্পানী সরকারের শিক্ষা ব্যবস্থা সফল হয়েছিল মুসলমানদেরকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। হিন্দুরা তাদের সবকিছু মেনে নিয়ে তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটায়। আর মুসলিমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্ত করে। মূলত ইংরেজ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মুসলমানদের প্রতি গভীর চক্রান্ত। মুসলমানদের এই পশ্চাৎপদতা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং কয়েকজন মুসলিম নেতা মাধ্যমে মুসলিমরা বিশেষ কিছু সুবিধা আদায় করে।
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
আরও পড়ুন-
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ।। Shah Wali Ullah
আরও পড়ুন-
নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
বক্সারের যুদ্ধ এবং নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান
আরও পড়ুন-
আকবরের ধর্মনীতিঃ দীন-ই-ইলাহী।। প্রেক্ষাপট, মূলনীতি এবং সমালোচনা
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment