Breaking

Saturday 26 August 2023

ফরায়েজী আন্দোলন: কার্যক্রম ও গতি-প্রকৃতি


ফরায়েজী আন্দোলন: কার্যক্রম ও গতি-প্রকৃতি


পলাশীর প্রান্তরে রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোর পর মুসলিমরা ধীরে ধীরে স্বীয়  আভিজাত্য, রীতিনীতি, সাংস্কৃতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ হারাতে শুরু করে। তারা  নিজেদের আত্ম পরিচয় ভুলে গিয়ে হিন্দুয়ানি রীতিনীতিতে ডুবতে শুরু করে। মুসলমানদেরকে এই অবস্থা থেকে বের করে আনার জন্য একজন সংস্কার হিসেবে আবির্ভূত হন হাজী  শরীয়ত উল্লাহ। তার নেতৃত্বে ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ফরায়েজী আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মানুষের অধিকার আদায় এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করতে গিয়ে ফরায়েজী আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে  পরিণত হয়। ফরায়েজীরা ঈমান, আকিদা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং শিক্ষা সংস্কৃতিতে মুসলমানদের সজাগ করে তোলার পাশাপাশি ইংরেজ ও জমিদারদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। 




ফরায়েজী আন্দোলনের পরিচিতি:

আরবি শব্দ ফরজ থেকে ফরায়েজী শব্দটির উৎপত্তি। যারা ফরজ পালন করে তারাই ফারায়েজি বলে পরিচিত। ইসলামে অবশ্যই পালনীয় কার্যাবলী কে ফরজ বলা হয়। কিন্তু ফারায়েজী আন্দোলনের অর্থ হল মুসলমানদেরকে আল্লাহর আদেশ মোতাবেক অবশ্যই পালনীয় ফরজ কার্যাবলীর ভিত্তিতে জীবন ধারণের অভ্যস্ত করা। ভারতের মুসলিমরা তখন সুন্নত, মুস্তাহাব তো দূরের কথা  ধর্মীয় ফরজ কার্যাবলী ভুলতে শুরু করেছিল হাজী শরীয়তুল্লাহ ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধির জন্য ইসলাম ধর্মের অবশ্যই পালনীয় নির্দেশ তথা ফরজগুলোর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন বিধায় এই আন্দোলনের নামকরণ হয় ফারায়েজি আন্দোলন।


ফরায়েজী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: 

পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাংলার পরিবর্তিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা ফরায়েজী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। পলাশীতে ক্ষমতা প্রতিপত্তি হারানোর পর মুসলমানদের আভিজাত্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মারাত্মক অবক্ষয় দেখা দেয়। ইসলামিক জ্ঞানে শিক্ষিত হাজী শরীয়ত উল্লাহ এসব দেখে মর্মাহত হন। মুসলমানদের এই অবস্থা হতে মুক্তির জন্য ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।


হাজী শরীয়তুল্লাহ এর পরিচিতি

হাজী শরীয়তুল্লাহ 1781 সালে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার শামায়েল গ্রামে তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 12 বছর বয়সে তিনি কলকাতা আসেন এবং মাওলানা বাশারত আলীর নিকট কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর হুগলি জেলার ফুরফুরাতে আরবী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। 1799 সালে তিনি মক্কায় হজ পালন করতে যান, সেখানে তিনি কোরআন, হাদিস  ও ফিকাহ শিক্ষা লাভ করেন। হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৮ বছর মক্কায় অবস্থান করেন এ সময় ওহাবী আন্দোলনের সাথে তার পরিচয় ঘটে। মিশরে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এক বছর পড়াশোনা করেন। অতঃপর তার অর্জিত শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ১৮১৮ সালে তিনি বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন।


ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত:

দেশে প্রত্যাবর্তনের পর হাজী শরীয়তুল্লাহ দেশীয় মুসলমানদের মাঝে নানা রকম শিরিক, বিদআত ও কুসংস্কার দেখতে পান। এগুলো দূরীভূত করে মুসলমানদেরকে ইসলামের মৌলিক বিধানাবলী তথা ফরজের উপর সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত  করেন।


 R.C মজুমদার বলেন-

Shariatullah founded the Faraidi sect for religious reforms and began to preach his doctrine in 1804 but he gradually turned it to political ends and declared the country under British occupation to be Darul-harb where true Muslim should not leave ( The Sepoy mutiny and the revolt of 1857, P. 57-58)


ফরায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-

  1. মুসলমানদেরকে ইসলামী মূলনীতি তথা ফরজের উপর প্রতিষ্ঠিত করা; 

  2. মুসলমান জাতির স্বকীয়তা পুনরুদ্ধারের জন্য ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা;

  3. ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ ও কুসংস্কার রোধে মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করা; 

  4. মুসলমানদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আত্মপ্রত্যয়ী সচেতন করে গড়ে তোলা; 

  5. মুসলমানদের ধর্মভীরু ও নৈতিক বলে বুলিয়ান করা; 

  6. ব্রিটিশ শাসক, জমিদার, মহাজন, আমলা ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। 


ফরায়েজী আন্দোলনের কার্যক্রম

ফরায়েজী আন্দোলনের কার্যাবলীকে আমরা মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ভাগ করতে পারি-


  1. ধর্মীয় সংস্কারমূলক কার্যক্রম:

ফরায়েজী আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছিল ধর্মীয় সংস্কার সাধন করার লক্ষ্যে। তাদের মৌলিক ধর্মীয় সংস্কার গুলো ছিল নিম্নরূপ-


  1. ইসলামের মূলনীতির উপর গুরুত্ব আরোপ 

লক্ষ্যভ্রষ্ট মুসলমানদের কে হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রথমে ইসলামের মৌলিক ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তিনি মুসলমানদেরকে ইসলামের ফরজ তথা মৌলিক কাজগুলো সম্পাদন করার আবেদন জানান। ইসলামের মূল ভিত্তি কালিমা, নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ এই পাঁচটির উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং এগুলো অবহেলা করা পাপ বলে ঘোষণা করেন। এই মৌলিক ইবাদত গুলোর প্রতি মানুষের কে তিনি সচেতন করে তোলেন। 


  1. সামাজিক কুপ্রথা নিষিদ্ধকরণ:

সে সময়ে মুসলমানরা হিন্দুদের মত নানা রকম অনৈসলামিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। যেমন পীর পূজা, কবর পূজা, সেজদা দেওয়া ইত্যাদি। শরীয়তুল্লাহ এগুলোকে পাপ বলে প্রচার করেন এবং এগুলো পরিহার করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান।  


  1. মাতৃভাষা ইসলাম প্রচার:

মুসলিম ধর্মাবত্তাগণ এদেশে আরবি ফার্সি ও উর্দু ভাষায় ইসলাম প্রচার করত। যা সাধারণ মানুষের কাছে  সহজে বোধগম্য ছিল না।  হাজী শরীয়তুল্লাহ এই নীতি বর্জন করে মাতৃভাষায় তথা বাংলাতে লোকদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে শুরু করেন এবং অনুসারীদেরকেও নির্দেশ দেন। বিতর্ক নির্মূল করার লক্ষ্যে তিনি পীরদেরকে ওস্তাদ এবং শিষ্যদেরকে সারগেদ বলে অভিহিত করেন। 


  1. জুমা ও ঈদের নামাজ অনাবশ্যক ঘোষণা:

ব্রিটিশ শাসনাধীন এই দেশকে হাজী শরীয়াতউল্লাহ দারুল হরব বলে ঘোষণা করেন। সেজন্য তিনি এদেশে জুম্মা এবং ঈদের নামাজ আদায় অনাবশ্যক বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন এদেশে কোন ইসলামী শাসক নেই ঈদ ও জুমার নামাজ শাসকদের উপস্থিতিতে পড়তে হয়, সেটা এখানে নেই। তাই তিনি জুমার নামাজের পরিবর্তে জোহর নামাজ পড়ার উপদেশ দেন। 




  1. বিভিন্ন কর রহিতকরন: 

কালীপূজা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি নানাবিধ হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য হিন্দু জমিদাররা মুসলিম কৃষকদের নিকট থেকে উৎসব করা আদায় করত। এমনকি মুসলিমদের দাড়ি রাখার উপরেও জমিদাররা  কর  আরোপ করেছিল। হাজী শরীয়তুল্লাহ প্রজাদের অর্থনৈতিক দূরদর্শার কথা বিবেচনা করে উৎসব করসহ সকল অবৈধ কর দিতে কৃষকদেরকে নিষেধ করেন। তার এই উদ্যোগে মুসলিম কৃষকরা অতিরিক্ত করার বোঝা থেকে রক্ষা পায়।


  1. সামাজিক বিভেদ দূরীকরণ

তৎকালীন সমাজে নিম্ন শ্রেণীর পেশাকে খাটো করে দেখা হতো। যেমন কুলি, কসাই, তাঁতি প্রভৃতি পেশার লোকদেরকে ঘৃণা করা হতো।  শরীয়তুল্লাহ সমাজে সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের উপর জোর দিয়ে ভেদাভেদ দূর করতে সচেষ্ট হন। তিনি ঘোষণা করেন- হালাল রুজি ইবাদতের পূর্বশর্ত, যারা জুলুম নির্যাতন করে জীবিকা নির্বাহ করে আল্লাহ তাদের ইবাদত কবুল করেন না। তিনি টেকনিক্যাল শ্রমিকদের নাম দেন কারিগর। এক্ষেত্রে তিনি সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করেন। 


 এ. আর. মল্লিক বলেন-

But his emphasis on the doctrine of the equality of men could not but attract the lower orders of the society to become members of the reforms sect (British policy and the Muslims in Bengal, first edition, 1961 Dhaka, P.69)


  1. আযান ও কোরবানির পূন:প্রচলন

হিন্দু জমিদাররা তাদের স্ব স্ব নিয়ন্ত্রিত এলাকাতে কুরবানী বন্ধ করেছিল, গরুর মাংস আহার এবং আযান দেয়া নিষিদ্ধ করেছিল। হাজী শরীয়ত উল্লাহ এসব বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা কুরবানী করেন এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আযানের দেয়া শুরু করেন। 


  1. তাৎক্ষণিক ধাত্রী সেবা প্রধান:

সমাজে তৎকালীন সমাজে একটি কুপ্রথা চালু ছিল; কোন মহিলা সন্তান প্রসব করলে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া সন্তানের নাড়ী কাটানো যেত না। এতে করে অনেক সময় সন্তান প্রসব হওয়ার পরেও নির্ধারিত লোক না পাওয়া বা বিলম্বে আসার কারণে সন্তান বা মায়ের মৃত্যু ঘটতো।  হাজী শরীয়তুল্লাহ ঘোষণা দিলেন যে এই পরিস্থিতিতে স্বামীই নাড়ী কাটতে পারবে। এই ঘোষণার ফলে সমাজে ব্যাপারটা সহজ ও নিরাপদ হয়ে যায়। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীরা এই কাজকে ঘৃণা করে প্রচার করে এবং তাদেরকে নাড়ীকাটা বলে সম্বোধন করা শুরু করে।  


  1. রাজনৈতিক কার্যক্রম

হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজী আন্দোলনকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখলেও তার ছেলে মোহসিন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া ফরায়েজী আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপদান করেন। দুদুমিয়া মক্কাতে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে আসেন। জমিদারদের সাথে ফরায়েজীদের সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শিষ্যদের সমন্বয়ে এটাকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। 


  1. লাঠিয়াল বাহিনী গঠন:

দুদুমিয়া তার সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করেন নিজে লাঠি চালনা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। ফরায়েজী আন্দোলনের প্রতি মানুষের সমর্থন এবং অবৈধ কর বন্ধ ইত্যাদি কারণে হিন্দুর জমিদাররা ফরায়েজীদের উপর চড়াও হত।  এদেরকে প্রতিরোধকল্পে  হাজী শরীয়ত উল্লাহ প্রথমে লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করলেও দুদুমিয়া সেই বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করেন। তিনি জালালউদ্দিন মোল্লাকে সেনাপতি নিয়োগ করে এক সুদক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলেন। 


  1. কানাইপুরের জমিদারের বিরুদ্ধে অভিযান:

দুদুমিয়া ফরায়েজী আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর জমিদারদের  অন্যায় কাজে বাধা দিতে গিয়ে সংঘর্ষ বাধে। গরু কোরবানি দেয়া, উৎসব কর না দেয়া ইত্যাদি কারণে জমিদাররা তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়। অনেক সময় অত্যাচার করতে বলে জানা যায়। এতে দুদুমিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে কানাইপুরের জমিদারের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। জমিদার তার সাথে মোকাবেলা করার সাহস না করে আপোষ করেন এবং অন্যায় কর প্রত্যাহার করে। 


  1. ঘোষ পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযান:

বিভিন্ন কারণ ও অত্যাচারের প্রেক্ষিতে ফরায়েজীরা দুদুমিয়ার নেতৃত্বে ১৮৪২ সালে ফরিদপুরের ঘোষ পরিবারের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে। তারা জমিদারদের বাসগৃহ বিধ্বস্ত করে এবং জমিদারের ভাই মদন নারায়ন ঘোষকে বন্দী করে রাখে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দুদুমিয়াসহ ১৭৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সাক্ষ্য প্রমানের অভাবে দুদুমিয়া নির্দোষ বলে মুক্তি পান। এতে তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায় এবং তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিন্দু জমিদারদের প্ররোচনায় নীলকরেরাও তাকে বারবার মিথ্যা অজুহাতে গ্রেফতার করে কিন্তু তিনি প্রতিবারই নির্দোষ হিসেবে মুক্তি পান।



  1. কালিপ্রসাদ কাঞ্চিলালের  বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ:

পঞ্চচড় নীলকুঠিতে ডানলপের গোমস্তা কালি প্রসাদ কাঞ্চিলালের দৌড়াতে প্রজাগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কালীপ্রসাদ কাঞ্চিলাল দুদুমিয়ার বাড়িতে লোকজন নিয়ে ডাকাতি করে এবং অর্ধ লক্ষ টাকার মালামাল লুট ও চারজন চৌকিদারকে হত্যা করে। দুদুমিয়া থানায় মামলা দিতে গেলে ডানলপের প্রভাবে পুলিশ মামলা গ্রহণ করেনি। ফলে দুদুমিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। তার শিষ্য কাদির বক্স একদল লাঠিয়াল নিয়ে ১৮৪৬ সালে ৫ ডিসেম্বর পঞ্চচড় নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং তা  জ্বালিয়ে দেয়। কাঞ্চিলালকে হত্যা করে কেটে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। এই পরিপেক্ষিতে দুদুমিয়া ও অন্য ৬৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় জিলা কোর্টে। তারা দোষী সাব্যস্ত হয় অতঃপর সদর নিজাম মত আদালতে আপিল করলে তারা খালাস পান। এর পর নীলকর ও জমিদাররা দুদুমিয়াকে সমীহ করে চলতো।  প্রজারাও জমিদার ও নীলকরদের হাত থেকে রক্ষা পায়। 


  1. অর্থনৈতিক কার্যক্রম:

আন্দোলনের পাশাপাশি ফরায়েজীরা কিছু অর্থনৈতিক কাজও করেছিল। অবৈধ কর প্রদান বন্ধকরাসহ ফরায়েজী অধ্যুষিত এলাকাতে শরীয়তুল্লাহ ও দুদুমিয়া কর নির্ধারণ ও আদায় করতেন এবং সেসব অর্থ তাদের প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করতেন। 


  1. পঞ্চায়েত ও বিচার:

ফরায়েজিরা সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সীমিত  পরিসরে বিচার ব্যবস্থা ও সালিশ গঠন করেছিল। তাদের এই ব্যবস্থাকে বলা হতো পঞ্চায়েত আদালত। সংগঠনের সর্বোচ্চ প্রধান ব্যক্তি হিসেবে হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং দুদুমিয়া বিচারকার্য সম্পাদন করতেন। এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ইংরেজরা ফরায়েজী অধ্যুষিত এলাকাকে  “State within the state” (দেশের ভিতরে আরেক দেশ) বলে আখ্যায়িত করেছিল। 

 

  1. প্রশাসনিক কার্যক্রম:

ফরায়েজীদের একটি  প্রশাসনিক কাঠামো ছিল। ফরায়েজী অধ্যুষিত ছয়টি এলাকা নিয়ে একটি খেলাফত গঠন করা হয়েছিল। প্রতি গ্রামে একজন খলিফা ছিলেন, কয়েক গ্রামের খলিফাদের নিয়ে সুপারিনটেনডেন্ট খলিফা এবং এদের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় খলিফা নির্ধারণ করা হতো। এসব ইউনিটের মাধ্যমে ফরায়েজী প্রশাসন পরিচালিত হতো।  



ফরায়েজী আন্দোলনের পরবর্তী ইতিহাস:

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় দুদুমিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৮৬২ সালে তিনি মারা যান। পরবর্তীতে তার পুত্র গাজী উদ্দিন হায়দার 1862-64, আব্দুল গফুর ওরফে নয়া মিয়া 1864-83, খান বাহাদুর সাইদ উদ্দিন আহমদ 1883-1903 ফরায়েজীদের ওস্তাদ বা নেতা নির্বাচিত হন। সাইদ উদ্দিন বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন।  অতঃপর তার পুত্র বাদশা মিয়া ওস্তাদ নির্বাচিত হন। তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিছুকাল তাকে অন্তরীন রাখা হয়। ১৯৫১ সালে তিনি মারা গেলে ফরায়েজী আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। 


ব্যর্থতার কারণ

ফরায়েজী আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পেলেও এটা গণমানুষের আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠেনি। যে সমস্ত কারণে ফরাজী আন্দোলন  ব্যাপক সফলতা পায়নি  সেগুলো হল-

  1. রক্ষণশীল মুসলমানদের বিরোধিতা 

  2. হিন্দুদের চরম বিরোধিতা 

  3. জমিদারদের বিরোধিতা 

  4. তিতুমীর সম্প্রদায়ের সামর্থনের অভাব 

  5. সরকারের বিরোধিতা।


মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত করা ফরায়েজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল। ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি তারা মুসলমানদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখান এবং  তাদের মধ্যে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। প্রভাব প্রভাবশালী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এই অসম সাহসী ফরায়েজী নেতাদের সংগ্রাম বাংলার ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়। ফরায়েজী আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, নেতৃবৃন্দ প্রথমদিকে রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও তাদের অনুসারীদের স্বার্থে এবং বাধ্য হয়ে অনেক রাজনৈতিক  সিদ্ধান্ত নিতে কুণ্ঠিত হননি। সর্বোপরি শিরিক বিদআত থেকে মুসলমানদেরকে দূরে রেখে ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে  ফরায়েজী আন্দোলনের ব্যাপক অবদান রয়েছে। 





আরও পড়ুন-

ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান


আরও পড়ুন-

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ।। ‍Shah Wali Ullah 


আরও পড়ুন-

নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত

আরও পড়ুন-

বক্সারের যুদ্ধ  এবং  নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান 

আরও পড়ুন-

আরও পড়ুন-







Md. Billal Hossain

B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka

BCS (General Education)

Lecturer

Department of Islamic History and Culture







 







No comments:

Post a Comment