বাংলায় ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ:
রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে ভিক্ষুকদের সশস্ত্র সংগ্রাম
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দেখা দেয়। শাসন ক্ষমতার বাইরে থেকে যারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে প্রথম চ্যালেঞ্জ করেছিল তারা হচ্ছে ফকির ও সন্ন্যাসী। বাংলায় ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল একটি অভূতপূর্ব আন্দোলন । এরকম বিদ্রোহ সচরাচর বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না। সমাজে যারা ভিক্ষা করে খায় যাদের কোন নির্দিষ্ট আবাসস্থল নাই, তারা কি না রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বিদ্রোহ গড়ে তুলেছিল যা ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কোম্পানি সরকারকেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের বেশকিছু কারণ ছিল। প্রথমদিকে বেশ সফলতা পেলেও শেষ পর্যন্ত অন্যান্য আন্দোলনের মতো ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
ফকিরদের পরিচিতি:
ফকিরগণ সুফি সম্প্রদায় ভুক্ত সাধক ছিলেন। তারা সুফি মতবাদের সাথে হিন্দু যোগীদের ভাবধারা গ্রহণ করে। এতে সন্ন্যাসীদের সাথে সুফিবাদের সমন্বয়ে ঘটে। এরা ছিল সশস্ত্র। এদের কোমরে শিকল ও ছুরি, হাতে ধারালো ত্রিশূল থাকতো। তারা মাথায় কালো পাগড়ি পড়তো এবং হাতে কালো পতাকা ধারণ করত। শরীরে ছাই মাখিত। এরা শরীরচর্চা কে আধ্যাত্মিকতার অংশ মনে করত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ফকির ও সন্ন্যাসীরা এই বিদ্রোহ করেছিল বলে এর নাম ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। । সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দিতেন দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক আর ফকিরদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফকির মজনু শাহ ও তার পরবর্তী ফকিররা। 1773 সালের এক পত্রে ওয়ারেন হেস্টিংস লিখেছেন যে, ভারতের মধ্যে ফকির ও সন্ন্যাসীগণ সর্বাপেক্ষা বেশি সাহসী ও কর্মক্ষম লোক। জনসাধারণ তাহাদিগকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে সেজন্য তাহারা ফকির ও সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে কোন তথ্য সরকারি কর্মচারীরদিগকে সরবরাহ করে না।
ফকিরদের শ্রেণীবিভাগ:
ফকিরদের কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় যেমন-
মাদারী ফকিরঃ
মাদারি ফকিরদের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান সুফি ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম ইসলাম প্রচারক হযরত বদীউদ্দীন জিন্দাশাহ মাদার। কথিত আছে যে শাহ মাদার হিন্দুস্তানে যোগী হয়েছিলেন সেজন্য অনেক হিন্দু তাকে ভক্তি করত।বিহারের কানপুর জেলার মাখনপুরে ছিল তাদের মূল আস্তানা।ওই আস্তানা থেকে ফকিররা বাংলাদেশে আসতো মুষ্টি সংগ্রহ এবং বাংলায় অবস্থিত বিভিন্ন দরগা জিয়ারত করার জন্য। তখন এদের সাথে যুক্ত হত স্থানীয় ভবঘুরে ফকিররা।
বুরহানা/কলন্দর ফকিরঃ
মাদারিয়া তরিকা থেকে উদ্ভূত ফকির হযরত শাহ সুলতান হাসান মাদিয়া বুরহানা এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। এই সম্প্রদায়ের ফকিররা বুরহারা নামে এক টুকরা কাপড় পরিধান করত। সেজন্য তারা বুরহানা নামে পরিচিত ছিল।
অবস্থানের বিচারে ফকিরদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
ভবঘুরের সংসার ত্যাগী ভ্রাম্যমান ফকির:
এরা ছিল সম্পূর্ণরূপে সংসার ত্যাগি এবং তাদের নির্দিষ্ট কোন আবাসস্থল ছিল না। তারা সারা বছর এক ধর্মস্থান বা তীর্থস্থান থেকে অন্য তীর্থস্থানে ভ্রমণ করে বেড়াতো
আবাসিক ফকির:
আবাসিক ফকিরেরা বিভিন্ন স্থায়ী দরগা এবং খানকা প্রতিষ্ঠা করে সংসার ত্যাগী না হয়েও আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাকেরগঞ্জের বলাকি শাহ, কুমিল্লার হুলি ফকির এবং সিলেটের আগাম মোহাম্মদ রেজা।
বিদ্রোহের কারণসমূহঃ
কোম্পানির শাসনের বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি:
ঐতিহাসিক এম এ রহিমের মতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখিয়া ফকির ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হয়। সাধারণত আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত এই নিরীহ সাধক সম্প্রদায় এই সময় তাহাদের পার্থিব আকাঙ্ক্ষা মিটাইতে সুযোগ পায়। ইহারা বাংলাদেশে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সঙ্ঘবদ্ধভাবে সংগ্রামে লিপ্ত হয়।……ফকিরগণ ভিক্ষা করিয়া বেড়াইত কালক্রমে তারা শক্তিশালী হইয়া উঠে এবং জনসাধারণের নিকট হইতে জোর করিয়া নজরানা আদায় করিতে শুরু করে।
কোম্পানির নিপীড়নমূলক রাজস্ব নীতি:
১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানির গৃহীত রাজস্ব নীতি এদেশের কৃষক সমাজের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।বর্ধিত রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হয়ে অনেক রায়াত জমি ও বাড়ি-ঘর ছেড়ে পলায়ন করে এবং জীবন বাঁচাতে ফকির ও সন্ন্যাসীদের দলে যোগ দেয়।
নবাবের সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়া:
পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর কার্যত বাংলার সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পড়ে। এই সেনাবাহিনীর একটি বিরাট অংশ ফকির ও সন্ন্যাসীদের দলে যোগ দেয় যা ফকিরদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করে।
১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ:
1769-70 সালে বাংলায় ৭৬ এর মন্বন্তর নামে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তাতে প্রায় অর্ধেক মানুষ না খেয়ে মারা যায়। যেহেতু ফকির ও সন্ন্যাসীরা একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী সেহেতু অন্তত বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক মানুষ ফকিরও সন্ন্যাসীদের দলে যোগ দেয়।
জমিদার কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা দান:
স্থানীয় অনেক জমিদার ফকির ও সন্ন্যাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা করত বিশেষ করে জমিদার দেবী চৌধুরানীর সাথে ফকিরও সন্ন্যাসীদের বেশ সখ্যতা ছিল। এছাড়া দস্যু সরদার ভবানী পাঠক ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলনের অন্যতম শক্তি ছিলেন।
লাখেরাজ বাতিল করণ:
মুঘল আমলে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ কিছু লাখেরাজ ভূমি পেয়েছিলেন অন্তত যা দিয়ে তাদের জীবনবিবাহ হতো। কিন্তু কোম্পানির সরকার লাখেরাজ বাতিল করলে তারা ভয়ানক বিপদে পড়ে। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাদের অনেকেই ফকিরও সন্ন্যাসীদের দলে যোগ দিয়ে তাদের দল ভারি করে।
মুষ্টি সংগ্রহে বাধা দান:
মুষ্টি সংগ্রহ এবং নজরানা আদায় ছিল ফকিরদের আয়ের প্রধান অবলম্বন। কোম্পানি মনে করত ফকিররা তাদের আয়ের উপরে ভাগ বসাচ্ছে। সেজন্য কোম্পানির সরকার আইন করে মুষ্টি সংগ্রহকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং তাদেরকে ডাকাত দস্যু বলে আখ্যায়িত করে। ফলে ফকিররা ক্ষিপ্ত হয়।
সঙ্ঘবদ্ধ চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আরো:
ফকিররা দল বেধে চলাফেরা করতো। এক সময় ফকিরদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে। কোম্পানির সরকার ফকিরদের সঙ্ঘবদ্ধ চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ফকিররা ক্ষিপ্ত হয়।
ফকিরদের বিরুদ্ধে হয়রানি মূলক মিথ্যা মামলা:
ফকিরদের দমন করার জন্য কোম্পানির সরকার ফকিরদের বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি শুরু করে।
আয় হ্রাস পাওয়া:
জনগণের কাছ থেকে মুষ্টি এবং উপহার সংগ্রহের পাশাপাশি জমিদারের কাছ থেকেও ফকির ও সন্ন্যাসীরা নাজরানা পেত। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জমিদাররাও তাদেরকে নাজরানা দিত। কিন্তু কোম্পানির অতিরিক্ত রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে তাদের আয় কমে গেলে জমিদারদের কাছ থেকে পূর্বের মতো নাজরানা পাওয়া যেত না। ফলে ফকিরদের আয় কমে গিয়েছিল। ফকিরদের দান সদকা এবং নজরানা কমে যাওয়ার পেছনে কোম্পানির রাজস্ব নীতি দায়ী বলে ফকিরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।
ফকির হত্যাকাণ্ড:
১৭৭১ সালে সরকার হয়রানির পাশাপাশি প্রায় বিনা কারণে ১৫১ জন ফকিরকে হত্যা করে যা ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করে।
বিদ্রোহের ধারাবাহিকতা/ঘটনা প্রবাহ:
১৭৬০ সালে প্রথম বিদ্রোহ হয় বর্ধমানে। ১৭৬৩ সালে কোম্পানির কর্মচারীদের উৎপাত এর বিরুদ্ধে সন্ন্যাসীরা বাকেরগঞ্জের কুঠি লুট করে। সেই বছরই সন্ন্যাসীরা কোম্পানির ঢাকা কুঠি আক্রমণ করে ও প্রচুর অর্থ এবং অস্ত্র লাভ করে। ১৭৬৩ সালে সন্ন্যাসীরা রাজশাহী কুঠি আক্রমণ করে কুঠিয়াল বেনেটকে বন্দী ও পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। ১৭৬৯ সালে সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে প্রেরিত সামরিক অভিযানে লেফটেন্যান্ট কিথের মৃত্যু ঘটে।
ফকির বিদ্রোহের অন্যতম নেতা মজনু শাহ বোরহানা। তিনি বিহার থেকে বাংলায় আসেন এবং উত্তরবঙ্গে আস্তানা গড়ে তুলেন তার আক্রমণ শুরু হয় ১৭৭১ সালের দিকে । ১৭৭০-৭১ সালে দিনাজপুরে ফকিরদের সঙ্গে কোম্পানির বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং কোম্পানির বাহিনী পিছু হটে। 1771 সালে ফকির মজনু শাহ সারা উত্তরবঙ্গব্যাপী এক বড় রকমের ব্রিটিশ বিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। তার মোকাবেলায় দিনাজপুর রংপুরে অতিরিক্ত ব্রিটিশ সৈন্য ও সিপাহী মোতায়ন করা হয়। 1773 সালে সন্ন্যাসীদের সাথে এক যুদ্ধে ক্যাপ্টেন টমাস পরাজিত ও নিহত হন। ১৭৭১ সালে বগুড়ার ঘোড়াঘাটে ফকিরদের সাথে কোম্পানির বাহিনীর এক সংঘর্ষে প্রায় ১৫০ জন ফকির নিহত হয়। 1772 সালে তিনি রাজশাহী আক্রমণ করেন। গেরিল কায়দায় যুদ্ধ পরিচালনা করা ছিল তার কৌশল। ১৭৭৪ সালে ফকির বাহিনী পুনরায় ঢাকা আক্রমণ করে দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৭৭৬ সালে ফকির বাহিনীর গুলিতে কোম্পানির সেনা কর্মকর্তা রবার্টসন গুরুতর আহত হন এবং কোম্পানির বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৭৮৬ সালে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত বাহিনী ময়মনসিংহ ও অল্প সিংহ পরগণায় অভিযান চালায়। ১৭৮২-৮৩ সালের দিকে রংপুরের কৃষক বিদ্রোহে ফকির সন্ন্যাসীরা অংশগ্রহণ করে।
ফকির ও সন্ন্যাসীদের একত্রিকরণ
হেনরি লজের মতে ১৮৮২ সালে ময়মনসিংহে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের মধ্যে একটি সংঘর্ষ হয়, এতে সন্ন্যাসীরা হেরে যায়। এরপর সন্ন্যাসীদের তৎপরতা আস্তে আস্তে কমতে থাকে এবং ফকিরদের প্রতিরোধ বাড়তে থাকে। অনেক সন্ন্যাসীরা ফকিরদের সাথে যোগ দেয়, এতে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সিম্মিলিত বাহিনী গড়ে ওঠে। এই যৌথ বাহিনী ফকির মজনু শাহ এর নেতৃত্বে প্রায় প্রতি বছরই কোম্পানির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৭৮৬ পর্যন্ত প্রতি বছরই ফকির মজনু শাহ কোম্পানির বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। জমিদার দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক নামক স্থানীয় দস্যু সর্দার মজনুসার অনুগত্য ছিল। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নতুন মাত্রা পায়। ১৭৮৭ সালে বগুড়া জেলার মঞ্জুরার যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ব্রেনানের অতর্কিতে আক্রমনে ফকিরবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ফকির মজনু শাহ গুরুতর আহত হন এবং পরের বছর তিনি মারা যান।
মজনু শাহ মারা যাওয়ার পর ফকিরদের নেতৃত্ব দেন মুসা শাহ। মুসা শাহের পরে নেতৃত্ব দেন চেরাগ আলী শাহ, পরাগল শাহ, সোবহন সিংহ, মাদার বাক্স, জরি শাহ, করিম শাহ এবং রওশন শাহ। ফকিরদের মধ্যকার আন্তঃকোন্দল এবং সাংগঠনিক শক্তির অভাবে আস্তে আস্তে এই আন্দোলন দুর্বল হতে থাকে। ভবানী পাঠক মারা গেলে এ আন্দোলন আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। যদিও ১৮০০ সাল পর্যন্ত ছোট-খাটো বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলা চলতে থাকে। এরপর ফকির আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায়।
শেরপুরের পাগল পন্থী বিদ্রোহ:
ফকিরদের মধ্যে করিম শাহ উত্তরবঙ্গে আরেকটি বিদ্রোহের সূত্রপাত করেন যার নাম পাগল পন্থী বিদ্রোহ। করিম শাহ পারস্য কায়দায় নিজেকে দিওয়ানা বা মাস্তানা না বলে বলতেন পাগল। এজন্য করিম পাগলের শিশুরা পাগলপন্থী নামে পরিচিত। এদের বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল জমিদার কর্তৃক প্রজা নির্যাতন। করিম শাহ এর পরে আসেন টিপু শাহ। টিপু শাহ তার শিষ্যদেরকে চিরাচরিত হারের উর্ধ্বে খাজনা না দিতে নির্দেশ দেন। ১৮২৫ সালে টিপু শাহের শিষ্যরা নতুন নতুন জমিদারদের বাড়ি আক্রমণ ও লুট করে এবং কয়েকজন গোমস্তকে হত্যা করে। টিপু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ওই অঞ্চলের শাসক বলে দাবি করেন। ১৮২৭ সালে কোম্পানির সরকার টিপুকে পরাজিত ও বন্দী করে। কিন্তু পাগলপন্থীদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পেলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৮৩৩ সালে ৩০০০ পাগলপন্থী শেরপুর শহর আক্রমণ করে এবং সব কয়টি সরকারি ভবন ও পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। শেরপুর থেকে গারো পাহাড় পর্যন্ত সমস্ত এলাকা পাগল রাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়। অতিরিক্ত সেনাবাহিনীসহ কোম্পানির সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে এবং টিপু শাহসহ ৩০০ জনের বিচার করা হয়। এদের মধ্যে ১৫ জনের ফাঁসি, ১৫০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ২৫ জনকে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। টিপুশাহকে নির্বাসন দেওয়া হয় । কিন্তু শান্তি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৮২৫ থেকে ১৮৩৩ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
আবাসিক ফকিরদের বিদ্রোহ
বাকেরগঞ্জের বলাকি শাহ:
বাকেরগঞ্জের বলাকি শাহ ছিলেন একজন আবাসিক ফকির। তার বাসস্থান ছিল বাকেরগঞ্জ জেলা সলিমাবাদ পরগনার অন্তর্গত ঘাগরি গ্রামে। বলাকি শাহের বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন রাজনৈতিক সংগ্রাম। সলিমাবাদ, চন্দ্রদীপ ও সুজাবাদ পরগনার কৃষকদের অনেকেই ছিল বলাকি শাহের শিষ্য। ব্রিটিশ অনুগত জমিদার ও ইজারাদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য বলাকি শাহ ৫০০০ শিষ্য নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। চন্দ্রদ্বীপ ও সলিমাবাদ পরগনার বহু অত্যাচারী জমিদার, তালুকদার ও ইজারাদারদের তিনি বন্দি করেন। শাহ বন্দর নামে তিনি একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে একটি মাটির দুর্গ স্থাপন করেন। মুঘল আমলের সুজাবাদ দুর্গের বহু অকেজো কামান সংগ্রহ করে সেগুলি মেরামত করেন এবং আরো অনেক কামান, বন্দুক ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে তিনি তার নবনির্মিত শাহ বন্দর দুর্গ কে অস্ত্রসজ্জিত করেন।
রণপ্রস্তুতি সম্পন্ন করে বলাকি শাহ ১৭৯১ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফিরিঙ্গি সরকারকে ট্যাক্স না দিয়ে তাকে ট্যাক্স দেওয়ার নির্দেশ দেন। তার বিরুদ্ধে প্রেরিত জেলা কালেক্টর উইলিয়াম ডগলাসের বাহিনী পরাজিত হয়। কিন্তু ১৭৯২ সালে প্রেরিত এক বিশাল বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বলাকি শাহ পরাজিত ও বন্দি হন। ঢাকা প্রভিন্সিয়াল কোর্ট অফ সার্কিট সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করাতে তাকে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।
সিলেটের আগা মুহfম্মদ রেজা:
সমকালীন সরকারি নথিপত্রে সিলেটের আগা মুহাম্মদ রেজার বিদ্রোহ সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি জাতিতে মুঘল এবং সিলেটে অবস্থানকারী একজন ফকির ছিলেন। তিনি মুঘল ফকির নামেও পরিচিত ছিলেন। আগা মোঃ রেজা বিশ্বাস করতেন যে, এই দেশে ফিরিঙ্গি শাসন ৪০ বছরের স্থায়ী হবে। কিন্তু ইংরেজ রাজত্বের অবসানের কোন লক্ষণ না দেখে তিনি ইংরেজ খেদাও আন্দোলন শুরু করেন। তিনি মুঘল আমলের বেশ কিছু পুরাতন কামান সংগ্রহ করে সেগুলি মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করে তোলেন। তার অনুগত সাত হাজার সশস্ত্র ফকির নিয়ে কোম্পানি রাজত্বের বাইরে কাছারে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেখান থেকে তিনি সিলেট জেলার সমস্ত মুসলমান জমিদারদেরকে ইংরেজ সরকারকে উৎখাত করার জন্য তাকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা করার আবেদন জানান। জমিদারদের পক্ষ থেকে তিনি কোন সাড়া পাননি। ১৭৯৯ সালে আগা মোহাম্মদ রেজা তার ৫ হাজার সশস্ত্র অনুসারী নিয়ে সিলেট আক্রমণ করেন। কিন্তু কোম্পানির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে তিনি কিছু হটতে বাধ্য হন। তার পাঁচটি কামান ও অনেক গোলাবারুদ কোম্পানির হস্তগত হয়। কোম্পানির তাকে চূড়ান্তভাবে দমন করার জন্য এক বিশাল সামরিক অভিযান প্রেরণ করলে 1799 সালের 14 আগস্ট আগাম মুহাম্মদ রেজা ত্রিপুরা রাজ্যে পলায়নের করতে গিয়ে ধরা পড়েন। ঐ বছরই তার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
কুমিল্লার হুলি ফকির:
কুমিল্লার হুলি ফকির ছিলেন একজন আবাসিক ফকির। জমিদার দেবী সিংহের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তার এক ক্রীতদাস 1786-87 সালের দিকে কুমিল্লার হুলি ফকিরের দরবারে আশ্রয় নেয়। হুলি ফকির ওই ক্রীতদাসের পরিবারকে মুক্ত করে দেওয়ার জন্য দেবী সিংহের কাছে পত্র লিখেন। কিন্তু জমিদার দেবী সিংহ তার পত্রের প্রতি কর্ণপাত না করলে হুলি ফকির তার অনুসারীদের সঙ্ঘবদ্ধ করে আশেপাশের ইংরেজ কুঠিগুলো লুটপাট করেন এবং খাজনা আদায়ের বাধা প্রদান করেন। তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরিত হলে তিনি যুদ্ধ না করে আত্মগোপন করেন। এভাবে কয়েকজন আবাসিক ফকির কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করে তুলেছিলেন।
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ দমন প্রক্রিয়া
গোয়েন্দা নিয়োগ
ফকিরদের গতিবিধির লক্ষ্য করার জন্য সরকার নতুন পলিসি অবলম্বন করে। মাসিক ৬০ টাকা বেতনে স্থানীয় লোকদের মাঝ থেকে গোয়েন্দা নিয়োগ করে। তাদের অবস্থান শনাক্ত করার জন্য এই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।এ সকল গোয়েন্দাদের মাধ্যমে ফকিরদের অবস্থান সনাক্ত করা হয়। যেহেতু ফকিররা একই স্থানে দীর্ঘদিনের অবস্থান করত না
বিদ্রোহীদের কলাকৌশল আয়ত্তকরন:
ফকিরদের কে পরাস্ত করার জন্য তাদের যুদ্ধ কৌশল জানার প্রয়োজন ছিল। আর নিয়োজিত গোয়েন্দাদের মাধ্যমে কোম্পানির সরকার ফকিরদের গেরিলা কায়দার যুদ্ধ কৌশল অবগত হয় এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
সামরিক অভিযান:
গোয়েন্দা মারফত ফকিরদের অবস্থান সনাক্ত করা এবং তাদের যুদ্ধ কৌশল অবগত হওয়ার পর এবার কোম্পানির আকস্মিক ফকিরদের উপর সামরিক অভিযান চালায়। যার ফলশ্রুতিতে চূড়ান্ত অভিযানে ফকিররা পরাজিত হয়।
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ
ফকির ও সন্ন্যাসী বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিল কৃষক শক্তিশালী ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোন অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না
সমগ্র বাংলা বিহার ব্যাপী ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র বিদ্রোহ গড়ে তোলার ক্ষমতা ও সংগঠনিক শক্তি ফকির সন্ন্যাসীদের ছিল না
সন্ন্যাসীদের মুখে বন্দেমাতারাম ধনী শোনা যায় কিন্তু এদের থেকে ইংরেজদের বিরোধিত করে কি ধরনের শাসন করা চান সে সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট কোন ধারণা ছিল না
ফকির মজনু শাহ বাঙালি ছিলেন না এবং ফকিরদের তৎপরতায় স্থানীয় জনগণের খুব একটা সহযোগিতা ছিল না
আন্তঃকোন্দল ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ব্যর্থতার আরেকটি কারণ
কোম্পানির উন্নত রণকৌশল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সামরিক প্রযুক্তির কাছে ফকির ও সন্ন্যাসীদের পরাজয় ছিল অবশ্যম্ভাবী
নিয়োজিত গোয়েন্দাদের মাধ্যমে কোম্পানি সরকার সহজেই ফকিরদের আস্তানা সনাক্ত করে এবং তাদের কলাকৌশল রপ্ত করে। যা ফকিরদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতি
নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগার কারণেই ফকির ও সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহ করেছিল, দেশপ্রেমে উজ্জিবিত হয়ে নয়। ফকির ও সন্ন্যাসীদের অবাধ বিচরণে বাধা, মুষ্টি সংগ্রহের বাধা এবং তাদের প্রতি দমন পীড়ন এ সমস্ত কারণে তারা বিদ্রোহ করেছিল। দেশ স্বাধীন করা কিংবা জাতিকে রক্ষা করার জন্য তারা বিদ্রোহ করেনি। উত্তরবঙ্গে ফকিরদের যে বিদ্রোহ দেখা দেয় সেই ফকিরদের নেতৃবৃন্দ ছিলেন বাংলার বাইরে থেকে আসা। তাদের সংগ্রামকে জাতীয় সংগ্রাম হিসেবে আখ্যায়িত করা না হলেও কয়েকজন আবাসিক ফকির সচেতনভাবেই ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ করেছিলেন দেশবাসীকে রক্ষার জন্য। সুতরাং ভ্রাম্যমাণ ফকিরদের বিদ্রোহ আর আবাসিক ফকিরদের বিদ্রোহের উদ্দেশ্যের মধ্যে বেশ কিছু তফাৎ রয়েছে।
ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিক্রিয়া। ফকিরদের স্বার্থে আঘাত লাগলে তারা কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। প্রথম দিকে তারা বেশ সফলতা লাভ করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে কোম্পানি সফলতা লাভ করে। ফকির মজনু শাহ এর সাংগঠনিক শক্তি এই আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। মজনু শাহের মৃত্যুর পর এ আন্দোলন আস্তে আস্তে স্থিমিত হতে থাকে। যদিও এ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।
আরও পড়ুন-
ভারতীয় মুসলমানদের নবজাগরণে এবং আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে সৈয়দ আমীর আলীর অবদান
আরও পড়ুন-
শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী ।। Shah Wali Ullah
আরও পড়ুন-
নবাব আব্দুল লতিফ: বাংলার মুসলিম পুর্নজাগরনের অগ্রদুত
আরও পড়ুন-
বক্সারের যুদ্ধ এবং নবাব থেকে ফকির হওয়া মীর মুহাম্মদ কাশীম আলী খান
তথ্যসূত্রঃ
ডঃ মো, শাহজাহান, বাংলার ইতিহাস ১৭৬৫-১৯৪৭ খ্রি. আধুনিক যুগ, তূর্য প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭
ডঃ মুহাম্মদ আব্দুর রহিম বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ১৭৫৭-১৯৪৭,আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০০৫
ডঃ মুহাম্মদ আব্দুর রহিম ও অন্যান্য বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা ষোড়শ সংস্করণ, ২০১১
প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলন, বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি অনলাইন ভার্সন।
প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস 1704-1971, রাজনৈতিক ইতিহাস, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি
চৌধুরী শামসুর রহমান, বাংলার ফকীর বিদ্রোহ, ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকা, ১৯৮০
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History and Culture
No comments:
Post a Comment