ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসঃ আমাদের জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য
1.
ভূমিকা:
নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশী ভাষা,পুরে কি আশা?
কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর
ধারাজল বিনে কভু ঘুচে কি তৃষা?১
বৃষ্টির পানি ব্যতীত চাতক পাখির যেমন পিপাসা মিটে না, মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার গুরুত্বও সেরূপ। মাতৃভাষায় মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় অন্য ভাষায় সেরকম তৃপ্তি পাওয়া যায় না। মনের ভাব প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে ভাষার সৃষ্টি এবং বিশ্বময় ভাষার বৈচিত্র্য মহান আল্লাহর এক বিরাট নিয়ামত। ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য সর্ম্পকে আল্লাহ বলেন-, ‘তার আরো একটি নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।২ পবিত্র কোরআনে আরোও এসেছে ‘দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, তাকে কথা বলতে শিখিয়েছেন।৩ বিশ্বময় প্রচলিত হাজারো ভাষার মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা একটি অন্যতম ভাষা। বিশ্বের প্রায় ২২ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। মাতৃভাষার দিক থেকে এর অবস্থান পঞ্চম এবং অধিক ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে বিশ্বে এর অবস্থান সপ্তম।৪ বিশ্বময় বাংলা ভাষার এই অবস্থান এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে রয়েছে রক্তের ইতিহাস। হাজার বছর ধরে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের সেই মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ১৯৫২ সালে সংঘটিত হয় ভাষা আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাজপথে তাদের তাজা রক্তের বিনিময়ে আমাদের মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হতো। ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
2.
পাকিস্তান পূর্ব ভাষা বিতর্ক:
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৭-৫২ সালের মধ্যে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হলেও ভাষাবিতর্ক শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের অধিবেশনে দলের অফিসিয়াল ভাষা নিয়ে প্রশ্ন উঠে, যদিও তা তেমন গুরুত্ব পায়নি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯১৩ সালে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি উর্দুকে মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা করতে চাইলে এ.কে ফজলুল হক বিরোধিতা করেন। ফলে জিন্নাহ এর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। লাহোর প্রস্তাবের পর আবারও ভাষাবিতর্ক দেখা দেয়। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হিন্দিকে আর মুসলিম মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ উর্দুকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করে। তখন স্বল্প পরিসরে হলেও কেউ কেউ বাংলার কথা বলেন। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান যখন নিশ্চিত হয়ে যায় এসময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় মুসলিম শিক্ষাবিদরাসহ উত্তর ভারতের অনেক নেতৃবৃন্দ উর্দুকে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন। পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পত্র-পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন।
3.
ভাষা আন্দোলনের কারণ:
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ভাষাগত জনসংখ্যার একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ২৮.০৪% পাঞ্জাবি, ৫.৮% সিন্ধি, ৭.১% পশতুন, ৫৪.৬০% বাংলা,৭.২% উর্দু এবং বাকি অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিক। পরিসংখ্যান মতে উর্দু ছিল পাকিস্তানি ভাষাভাষির দিক থেকে ৩য় স্থানে। অন্যদিকে তৎকালিন পূর্ববাংলার প্রায় ৪.৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৪.১৩ কোটি ছিল বাংলা ভাষাভাষী। এই অঞ্চলে ৯৮% বাংলা এবং মাত্র ১.১% ছিল উর্দু ভাষী।৫ অথচ সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পাকিস্তানিরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। যার ফলশ্রুতিতে ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটে।
3 ক. সাংস্কৃতিক কারণ:
বাংলা নিছক একটি ভাষা নয় বরং বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ হচ্ছে বাংলা ভাষা। পাকিস্তানীদের বিদ্বেষ শুধু বাংলা ভাষার উপর ছিল না বরং বাঙালি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিও ছিল তাদের দারুন বিদ্বেষ। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ভাষার উপর আঘাত করে তারা মূলত বাঙালি জাতিসত্তা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সুতরাং বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতিসত্তাকে রক্ষার জন্য ভাষা আন্দোলন ছিল অপরিহার্য।।
3. খ. অর্থনৈতিক কারণ:
শুরুতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলেও এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণ নিহিত ছিল। পূর্ব বাংলার ৯৮ শতাংশ মানুষ ছিল বাংলা ভাষাভাষী। এদের একটি অংশ সরকারি চাকরি করে, অনেকে চাকরির প্রত্যাশী ছিল। এখানে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ হচ্ছিল। ভাষাজনিত জটিলতার কারণে বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজে এবং রাষ্ট্রে তাদের অবস্থান হারানোর ভয়ে শঙ্কিত ছিল। উর্দুকে সিভিল সার্ভিসের মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করলে এদেশের শিক্ষিত শ্রেণী চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে আর চাকরিজীবীরা ও চাকরি হারানোর ভয়ে শঙ্কিত ছিল। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় যে সরকারি চাকরিজীবীরা ভাষা আন্দোলনের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের শিক্ষিত শ্রেণী যদি চাকরি না পায় তাহলে দুই পাকিস্তানের মধ্যে চরম বৈষম্য দেখা দিবে। সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ভাষার প্রশ্নে আপস করার কোন সুযোগ ছিল না।
3. গ. রাজনৈতিক কারণ:
সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে সূত্রপাত ঘটলেও অচিরেই এর গুরুত্বের কারণে ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছে যে, এই আন্দোলনে যদি বাঙ্গালিরা জিতে যায় তাহলে রাজনৈতিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পূর্ব বাংলা রাজনীতিতে চালকের আসনে বসে যাবে। অপরদিকে পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেছেন যে, ভাষা আন্দোলনে যদি আমরা হেরে যাই তাহলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আমাদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ থাকবে না। ভাষা ও সংস্কৃতি হারানোর পাশাপাশি রাজনীতিতে আমরা দুর্বল হয়ে পড়বো। এ অবস্থায় উভয় পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড় ছিল। যার ফলশ্রুতে ভাষা আন্দোলন গতি লাভ করে। তাছাড়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দকে রাজনীতির বাইরে রাখার যে অপচেষ্টা পাকিস্তানীরা করেছে সেই হিসেবেও এ দেশের রাজনীতিবিদরা ভাষা আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
4.
আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্ব:
4. ক. তমুদ্দুন মজলিস গঠন:
১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম তমুদ্দুন মজলিস নামে একটি ইসলামিক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কাজ করেছিল। রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক এটিই প্রথম সংগঠন। এই সংগঠনটি “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই সংগঠনের মুখপাত্র ছিল সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা। আবুল হাশিম, কাজী মোতাহার হোসেন, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদসহ তৎকালীন মনীসীবৃন্দ এই পত্রিকায় লিখতেন।
4. খ. করাচি শিক্ষা সম্মেলন:
১৯৪৭ সালের ২৭ শে নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত সর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের ঘোষণা ভাষা বিতর্ককে নতুন মাত্র দান করে। এই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করা হয় এবং বিদ্যালয় ও প্রচার মাধ্যমে উর্দু ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। ৮ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এই সমাবেশে আবুল কাশেম, মনির চৌধুরীসহ অনেক মনীষীবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। শিক্ষক শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীরেও এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে।
4. গ. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন:
করাচি শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সামর্থনে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য তৎকালীন ছাত্র, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন তমুদ্দুন মসজিদের নেতা অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া। সংগঠনটি বাংলা ভাষার প্রতি সরকারি অবজ্ঞার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং জনগণের মাঝে পুস্তিকা ও লিফলেটের বিতরণের কাজ করে।
4. ঘ. গণপরিষদে দাবি উত্থাপন
১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি এর সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা করা এবং সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রস্তাব এনে সংশোধনী উত্থাপন করেন। তিনি ডাকটিকিট সহ সরকারি কাগজে বাংলা ব্যবহার না করার প্রতিবাদ জানান। গণপরিষদে মুসলিম লীগের সকল সদস্য একযোগে তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। খাজা নাজিম উদ্দিন, লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে একে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। কণ্ঠ ভোটে সংশোধনীটি বাতিল হয়ে যায়।
4. ঙ. প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ:
১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে কমরউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে সম্প্রসারণ করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের পক্ষ থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গণপরিষদে তার সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়।
4. চ. খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে ৮ দফা চুক্তি:
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। খাজা নাজিম উদ্দিন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলোচনায় বসেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ সরকার ও সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আট দফা চুক্তির মাধ্যমে আন্দোলনকে কিছুটা স্থিমিত করা সম্ভব হয়।
4. ছ. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর ঢাকা ঘোষণা:
১৯৪৯ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব নির্ধারিত সফরে ঢাকা আগমন করেন। ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি বলেন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু অন্য কোন ভাষা নয় এ ব্যাপারে কেউ যদি আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু।৬ ২৪ শে মার্চ কার্জন হলে দেওয়া ভাষণে তিনি আবারও ঘোষণা করেন Urdu and only Urdu will be
the state language of Pakistan। উপস্থিত ছাত্ররা নো নো বলে প্রতিবাদ জানায়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহ এর সাথে দেখা করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দিলেও জিন্নাহ তা অগ্রাহ্য করেন।
4. জ. বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র:
১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ এর মৃত্যুর পর খাজা নাজিম উদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন। এসময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। এসময় ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষায় আরবি বর্ণমালা প্রচলন এর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কে নিয়োগ দিতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বাংলা সাহিত্যকে তথাকথিত ইসলামিকরণ করার চেষ্টা করা হয়। ১৯৫১ পর্যন্ত সরকার বর্ণমালা উচ্ছেদের চেষ্টা করে।কিন্তু দেশের ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ফলে সরকার এসব ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
5.
ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব -
১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়। চূড়ান্ত পর্ব পূর্ণতা পায় বেশ কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে।
5. ক. খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণা:
১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডিতে এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দিন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২৬ শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
5. খ. প্রতিক্রিয়া ও ধর্মঘট:
খাজা নাজিমুদ্দিনের এই ঘোষণায় ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। প্রতিবাদ সভা থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করা হয়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘটে ডাক দেওয়া হয়। ৩০ জানুয়ারির ধর্মঘট পালন শেষে ৪ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।
5. গ. দ্বিতীয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন:
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এবং উদ্ভুত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের জন্য ১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরীতে একটি সর্বদলীয় সভা আহ্বান করা হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এতে সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সভায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন দলের ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। সভা থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা ও শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য বন্দীদের মুক্তি দাবি করা হয়।
5. ঘ. ৪ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট:
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা এবং প্রদেশের সর্বত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। হাজার হাজার ছাত্র বিক্ষোভ মিছিল সহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। ধর্মঘট শেষে ছাত্রসভা থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
5. ঙ. ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২:
একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য অত্যন্ত সুগঠিত ভাবে প্রস্তুতি চলতে থাকে। নেতৃত্বদানকারী সংগঠনগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১১ ও ১৩ই ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন। ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ব্যাজ বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে। আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিষয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল দশটার দিকে ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে উপস্থিত হতে থাকে এবং দশ জনের অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও শোভাযাত্রা শুরু করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিয়ে ছাত্রদের মিছিল সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে প্রথমে পুলিশ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এরপর পুলিশ কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ শুরু করে। পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। আত্মরক্ষার্থে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের সামনে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের সমবেত হলে পুলিশ ছাদের উপর গুলি চালায়। আব্দুস সালাম আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আব্দুল জব্বার শহীদ হন। এভাবে বাঙালি জাতি সেদিন মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য আত্মত্যাগ করে।
6.
ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব:
ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে চারটি সংগঠন-
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
- সর্বদলীয়
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
- গণতান্ত্রিক
যুবলীগ
- পূর্ব পাকিস্তান
মুসলিম ছাত্রলীগ
7.
ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
7. ক. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ:
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভীত রচনা করেছে। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের স্থলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়েছে। বাঙালিরা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে।
7. খ. অসাম্প্রদায়িক চেতনার সৃষ্টি:
ভাষা আন্দোলন এদেশের সকল ধর্মের মানুষকে একই কাতারে নিয়ে এসেছে। একটি কমন ভাষায় কথা বলার কারণে তারা ধর্মীয় বিভেদ ভুলে গিয়ে ভাষার প্রশ্নে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সৃষ্টি করেছে।
7. গ. ছাত্র সমাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি:
ভাষা আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল এ দেশের ছাত্রসমাজ। মাতৃভাষার প্রশ্নে তাদের অনমনীয় মনোভাব এবং আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে ছাত্র সমাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, এই ধারা স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
7. ঘ. অধিকার আদায়ের শিক্ষা:
মাতৃভাষা ছিল আমাদের জন্মগত অধিকার। কিন্তু পাকিস্তানিরা আমাদের এ অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে সফলতার মাধ্যমে আমরা অধিকার আদায়ের দীক্ষা লাভ করেছি।
7. চ. বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গুরুত্ব বৃদ্ধি:
ছাত্র সমাজের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অংশগ্রহণ ছিল। এদেশের সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবীসহ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যম ভাষা আন্দোলন পূর্ণতা পায়। পরবর্তী রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ বৃদ্ধি পায়।
7. ছ. আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি:
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালীদের প্রথম সফলতা। এই সফলতা পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বাঙালিরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক আন্দোলনে চালকের আসনে বসেছে।
7. জ. নারী সমাজের অংশগ্রহণ:
ভাষা আন্দোলনের পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। রক্ষণশীলতা ভেঙে এই প্রথম বাঙালি নারীরা অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
7. ঝ. বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি:
ভাষা আন্দোলনের সফলতা বিশ্বময় বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালের সংবিধানেও তা বহাল রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দানের মাধ্যমে বিশ্ব জানতে পেরেছে বাংলা শুধু একটি ভাষা নয় বরং বাঙ্গালিরা আত্মপ্রতিষ্ঠিত একটি জাতি। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিলে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ বিশ্ব সময়ে স্বীকৃত।
7. ঞ. বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা:
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ফলাফল হচ্ছে বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষণা, সাহিত্যচর্চা ও প্রচার ইত্যাদির উদ্দেশ্যে ১৯৫৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকায় অবস্থিত বর্ধমান হাউজে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে।
7. ট. শহিদ মিনার স্থাপন:
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য ঢাকার কেন্দ্রস্থলে তৈরি হয় শহীদ মিনার। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলেও পাকিস্তানীরা তা ভেঙে ফেলে। অতপর ১৯৫৬ সালে বর্তমান শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন করা হয়,১৯৫৭ সালে তার কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬৩ সালে শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হয়।
ঠ. স্বধীনতার বীজ বপন:
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপন করেছে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে তা চূড়ান্ত পরিনতি লাভ করেছে। সুতরাং ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি।
8. শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
১৯৯৯ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে বিশ্বের প্রতিটি ভাষার জনগণকে সচেতন করে তোলার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্তটি জানার পর বাংলা ভাষাভাষি কানাডীয় ১০ জনের মাতৃভাষা প্রেমিক একটি গ্রুপ একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রফিকুল ইসলাম নামের এক প্রবাসী বাঙালি তদানীন্তন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে প্রস্তাব প্রেরণ করেন। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসতে হবে। অতঃপর এ প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষে ইউনেস্কোতে পাঠানো হয়। তখন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে জাতিসংঘে ও প্যারিসে গিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ ই নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩১ তম সম্মেলনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রদান করে। যা বাংলা ভাষাকে এক বিশাল গৌরব ও খ্যাতি এনে দিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের ১৯১ টি দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এরই প্রেক্ষিতে বিশ্বময় মাতৃভাষার গবেষণা ও সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করার জন্য ২০০১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। ২০১০ সালে জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব স্থাপন করা হলে সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস হয় যা বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন এবং মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৩০ টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া থেকে বাংলা ভাষায় সংবাদ প্রচারিত হয় এবং বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের বাইরেও ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলা ভাষার টিভি চ্যানেল রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে একমাত্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামে বাংলা ভাষা চালু রয়েছে। এছাড়া সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
9. উপসংহার:
ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক সফলতা ও অনুপ্রেরণা। ১৯৫২ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে ভাষা আন্দোলন অনুপ্রণা হিসেবে কাজ করেছে। ৫২ সালে অঙ্কুরিত জাতীয়তাবাদ পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বিকশিত হয় এবং ১৯৭১ সালের পরিণতি লাভ করে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এনে দিয়েছে। আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাঙালির জাতীয় জীবনকে করেছে গৌরবান্বিত। প্রতি বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বের সকল জাতিগোষ্ঠী বাঙ্গালীদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। মাতৃভাষার দিক দিয়ে বাংলা বিশ্বে একটি শক্তিশালী ভাষা। বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলা ভাষারও বিশ্বায়ন হচ্ছে। পৃথিবীর দেশে দেশে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলা গণমাধ্যম, প্রিন্ট ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা বাঙালি জাতির জন্য এক বিরাট সফলতা। কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন-
ডালে ডালে পাখির বাসা , মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা,
সাত সাগরে নদীর বাসা , কুলু কুলু নদীর ভাষা।
হাজার সুরে, হাজার ভাষায় এই দুনিয়া ঘেরা
আর-মাতৃভাষা বাংলা আমার সকল ভাষার সেরা।।৭
তথ্যসুত্র:
- স্বদেশী
ভাষা, রামনিধি গুপ্ত
- আল
কুরআনুল
কারিম, সুরা রুম, আয়াত : ২২
- আল
কুরআনুল
কারিম, সুরা আর-রাহমান, আয়াত-1-4
- ডেইলি
স্টার বাংলা, মাতৃভাষা
হিসেবে
বিশ্বে
বাংলা
পঞ্চম
অবস্থানে, https://shorturl.at/kmDVX
- ওয়ালিউর রহমান, ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির জাতীয়তাবাদের বিকাশ, https://shorturl.at/aCUV1
- বদরুদ্দিন ওমর,পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি,
১ম খন্ড, 1995, পৃ.94
- ফররুখ
আহমদ, ভাষার গান
সহায়ক গ্রন্থাবলী:
- ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাস 1905-1971,বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী, ঢাকা
- এ কে এম শওকত আলী খান ও
অন্যান্য, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, গ্রন্থ কুঠির পাবলিকেশন, ঢাকা
- সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদিত ), বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪ -১৯৭১, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা
- বিপি রাকিবুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও
বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া, https://shorturl.at/htwV1
- সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য, https://shorturl.at/loNTY
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment