পারস্যের সাফাভী বংশ: পরিচিতি ও উত্থান
(1502-1736)
সাফাভীদের পরিচিতি
সাফাভী বংশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পারস্যে দীর্ঘকালের আরব ও মোঙ্গল প্রাধান্যের অবসান ঘটে এবং পারসিকরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাহ ইসমাইল। ১৫০২ সালে পারস্যে সাফাভী বংশ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৭৩৬ সাল পর্যন্ত তারা পারস্য শাসন করে। তৈমুরের রাজত্বকালে এই বংশের লোকেরা আজারবাইজানে অবস্থিত আর্দাবিল নামক শহরে বসবাস করত। সাফাভীগণ ইসলাম ধর্মের শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। তারা শিয়াদের সপ্তম ইমাম মুসা আল কাজিমের বংশধর বলে নিজেদেরকে দাবী করেন। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইল শিয়া ইসলামের ইছনা আশারিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন শাহ আব্বাস।
নামকরণ
শেখ সাফিউদ্দিন ইসহাক নামে এই বংশের একজন বিখ্যাত সুফি সাধক পুরুষ ছিলেন। তিনি সাফাভী বংশের প্রতিষ্ঠাতা শাহ ইসমাইলের প্রপিতামহ ছিলেন। শেখ সাফিউদ্দিন এর নামানুসারেই এই বংশের নামকরণ করা হয়েছে সাফাভী বংশ। তবে কিছু পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের ধারণা মতে ‘সুফি’ শব্দ থেকে সাফাভী বংশের নামকরণ করা হয়েছে।
সাফাভীদের রাজনৈতিক উত্থান
শেখ সাফিউদ্দিন (১২৫২-১৩৩৪) তার ধর্মনিষ্ঠার জন্য বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন। তারপর সুফি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তার বংশধর শেখ সদর উদ্দিন মুসা (1305-1391)। এই বংশের পরবর্তী বিখ্যাত সাধক ছিলেন শেখ খোজা আলাউদ্দিন (১৩৪৫-১৪২৪)। ইতিপূর্বে এই বংশের লোকেরা সুন্নি ইসলামের অনুসারী ছিল। খোজা আলাউদ্দিন তার ধর্ম নিষ্ঠার জন্য তৈমুর লং এর নিকট শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। খোঁজা আলাউদ্দিন এর অনুরোধে ১৪০২ সালে তৈমুর লং অঙ্গনার যুদ্ধে বন্দী সাতটি তুর্কি গোত্রকে মুক্তি দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে খোঁজা আলাউদ্দিন শিয়া ধর্ম গ্রহণ করলে তার সাথে সাথে মুক্তিপ্রাপ্ত সাতটি গোত্র শিয়া ধর্ম গ্রহণ করে। খোজা আলাউদ্দিন আলী সাফাভী নাম ধারণ করেন।
তৈমুর লং এর সময় এই গোত্রগুলো আজারবাইজানের আরদাবিল নামক শহরে বসবাস করত। তবে তাদের আদি নিবাস ছিল এশিয়া মাইনর এর দিয়ারবেকির অঞ্চলে। ইতিহাসে এরা কিজিলবাস বা লাল মস্তক ওয়ালা বলে পরিচিত। কেননা তারা ১২ টি ভাঁজ যুক্ত লাল পাগড়ি পরিধান করত। এই বারটি ভাজ ছিল তাদের শিয়া 12 জন ইমামের প্রতীক চিহ্ন।যে সাতটি গোত্র কে তৈমুর লং মুক্তি দিয়েছিলেন এবং যাদের মাধ্যমে সাফাভিদের উত্থান ঘটে সেই সাতটি গোত্র হচ্ছে -
ওস্তাদলু
শামলু
বাহারলু
নিকালু
জলখুদায়ের
কাজার এবং
আফশার
আলী সাফা বীর পর এই বংশের পরবর্তী সাধক ছিলেন-
শেখ ইব্রাহিম সাফাভী।
অতপর শেখ জুনায়েদ সাফাভী, তিনি শ্বেত মেষ বংশের উজুন হাসানের বোনকে বিবাহ করেছিলেন।
অতঃপর শেখ হায়দার সাফাভী, শেখ হায়দার ছদ্দবেশী দরবেশ ছিলেন বলে তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি বৈবাহিক সূত্রে তিনটি রাজবংশের সাথে মৈত্রী গড়ে তোলেন। তিনি-
জর্জিয়ার রাজকন্যা,
শ্বেত মেষ বংশের রাজকন্যা এবং
ত্রিবিজেন্দের (বাইজান্টাইন অধিভুক্ত) রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন।
তার চতুর্থ স্ত্রী ছিল সাধারণ রানী।
শ্বেত মেষ বংশের উজুন হাসানের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকুব পারস্যের ক্ষমতায় আসেন তিনি শেখ হায়দারের এই জনপ্রিয়তাকে দারুণ ভয় করতেন। হায়দারের মৃত্যু হলে ইয়াকুব হায়দারের তিন পুত্রকে 1488 সালে পার্সেপোলিসে বন্দী করেন। শেখ হায়দারের এই তিন পুত্রের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন শেখ ইসমাইল। তখন তার বয়স ছিল মাত্র এক বছর। তার মাকেসহ বন্দী করা হয়েছিল। তারা ১৪৮৯ সালে মুক্তি পান। মুক্তির কিছুদিন পর প্রথম দুই ভাইয়ের মৃত্যু হলে এই বংশের দায়িত্ব অর্পিত হয় শেখ ইসমাইলের উপর।
শাহ ইসমাইল এবং সাফাভী বংশ প্রতিষ্ঠা
শেখ ইসমাইলের বয়স যখন ১৪ বছর তখন পারস্যের শ্বেত মেষ বংশের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সাফাভিরা এই সুযোগ গ্রহণ করে। বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও ইসমাইল সাফাবি বংশের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অসীম সাহস ও সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী গঠন করে বাকু ও শামাখা দখল করেন। এরপর তিনি শ্বেত মেষ বংশের অধীনতা অস্বীকার করে আরদাবিলে স্বাধীন শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। শেখ ইসমাইল শ্বেত মেষ বংশের শাসক ইয়াকুবের পুত্র আলওয়ান্দ বেগকে পরাজিত করে সমগ্র আজারবাইজানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাব্রিজে রাজধানী স্থাপন করেন। পরের বছর শ্বেত মেষ বংশের অপর যুবরাজ মুরাদ খানকে পরাজিত করে ইরাক দখল করেন। এর মাধ্যমে সে তো বেশ বংশের পতন ঘটে। এবং শাহ ইসমাইলের উত্থান ঘটে। ১৫০২ সালে তার অভিষেক অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি ‘আবুল মুজাফফর শাহ ইসমাঈল আল হাদি আল ওয়ালি’ উপাধি ধারণ করে পারস্যের সিংহাসনে আরোহন করেন এবং নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন। ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেন সেই থেকে পারস্য অধ্যাবদি শিয়া রাষ্ট্র।
শাহ ইসমাইল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাফাভী রাজ বংশ 1502 সাল থেকে 1736 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পারস্য শাসন করে। শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে সাফাভী বংশের শাসকেরা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং তাদের আনুগত্য লাভে সক্ষম হয়। শাহ ইসমাইল, শাহ তাহমাসপ, শাহ দ্বিতীয় ইসমাইল এবং শাহ আব্বাস এই বংশের উল্লেখযোগ্য শাসক।
সাফাভী বংশের শাসকদের তালিকা
শাহ ইসমাইল (1502-24)
↓
শাহ তাহমাসফ (1524-76)
↓
শাহ দ্বিতীয় ইসমাইল (1576-78)
↓
শাহ মোহাম্মদ খোদা বান্দা (1578-87)
↓
শাহ আব্বাস (1587-1629)
↓
শাহ সাফী (1629-42)
↓
শাহ দ্বিতীয় আব্বাস (1642-1667)
↓
শাহ সুলাইমান (1667-94)
↓
শাহ সুলতান হোসাইন (1694-1722)
↓
শাহ দ্বিতীয় তাহমাসফ (1722-31)
↓
শাহ তৃতীয় আব্বাস (1731-1736)
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS (General Education)
Lecturer
Department of Islamic History Culture
No comments:
Post a Comment