খলিফা আল ওয়ালীদের রাজত্বকালে উমাইয়াদের সাম্রাজ্য বিস্তার
খলিফা আল-ওয়ালিদ এর রাজত্বকাল সাম্রাজ্য বিস্তারের দিক থেকে ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরব উজ্জল অধ্যায়। ঐতিহাসিক গীবন এটাকে স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। খলিফা আব্দুল মালেকের মৃত্যুর পর তার পুত্র আল ওয়ালীদ ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কের সিংহাসনে আরোহন করেন। তার দীর্ঘ ১০ বছরের শাসনকালে মুসলিম সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করে মুহাম্মদ বিন কাশিম, মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন জিয়াদ, কুতাইবা বিন মুসলিম প্রমুখ সেনাপতিদের বীরত্ব ও শৈার্য-বীর্য তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতার আসনে সমাসীন করেছে তার রাজত্বকালে মুসলিম রাজ্যসীমা এশিয়া ইউরোপ এবং আফ্রিকার প্রতিষ্ঠিত হয়
According to P.K Hitti-
The greatest builder however was al-Walid son of Abd-al-Malik whose rule was one of the comparative peace and opulence (History of the Arabs, P.221)
খলিফা আল-ওয়ালিদের পরিচয়
আল-ওয়ালিদ ছিলেন খলীফা আব্দুল মালিকের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র। তিনি হিজরী ৫০ সনে জন্মগ্রহণ করেন। আব্দুল মালিক তার মৃত্যুর পূর্বে তার ভাই আব্দুল আজিজ কে পুত্র ওলীদের স্বপক্ষে পদত্যাগ করতে প্রবৃত্ত করেন। কিন্তু আব্দুল আজিজ তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর কিছুকাল পর আব্দুল আজিজ মারা গেলে আল-ওয়ালিদ নির্বিঘ্নে উমাইয়া খেলাফতের পদেে আসিন হন। আল-ওয়ালিদ ৭০৫ থেকে ৭১৫ পর্যন্ত উমাইয়া খেলাফত পরিচালনা করেন। আল-ওয়ালিদ পিতার পদাংক অনুসরণ করেন। তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পূর্বাঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে বহাল রাখেন এবং তার ধমপ্রাণ চাচাতো ভাই ওমর বিন আব্দুল আযীজকে হেজাযের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ করেন। গৃহযুদ্ধের সময় মক্কা ও মদীনায় যে ক্ষতি সাধিত হয়েছিলো তিনি তা পূরণে অগ্রগামী হন। তিনি উভয় শহরে ব্যাপক সংস্কার সাধন ও বহু অট্টালিকা, প্রাসাদ নির্মাণ করেন। মসজিদে নববী সম্প্রসারণ করেন এবং পবিত্র কাবা ঘর পুণঃনির্মাণ করেন।
আল-ওয়ালিদের সময়ে উমাইয়াদের রাজ্য বিস্তার
খলিফা আল ওয়ালীদের রাজত্বকালে চতুর্দিকে উমাইয়া সাম্রাজ্যেরবিস্তৃতি ঘটেছে। । যথা-
কুতাইবা বিন মুসলিম - মধ্য এশিয়ায়
মুসা বিন নুসাইর - উত্তর আফ্রিকায়
তারেক বিন জিয়াদ - স্পেনে
মুহাম্মদ বিন কাসেম - ভারতে এবং
মাসলামা - এশিয়া মাইনরে উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান।
ক, মধ্য এশিয়া বিজয়
কুতায়বা বিন মুসলিম এর পরিচালনায় মুসলিম বাহিনী মধ্য এশিয়া বা ট্রান্স-অক্সিয়ানায় অভিযান পরিচালনা করে। কুতায়বা বলখ, তুখারিস্তান, বুখারা, খাওয়ারিজম প্রভৃতি অঞ্চল দখল করে। এই অঞ্চলে ছিল তখন তুর্কিদের আধিপত্য। কুতায়াবা ৭০৬ খ্রী. একে একে বলখ, তুখারিস্তান ও ফারগানা অভিযান পরিচালনা করেন। মুসলিম বাহিনী এই সকল অঞ্চল তাদের পদানত করে। ৭০৯ খ্রী. তুখারিস্তানে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭১০ থেকে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সমরকন্দ ও খাওয়ারিজম পদানত হয়। খাওয়ারিজমের শাহ মুসলিমদের সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হন। কুতায়বা ৭১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খোজান্দা, শাশ্, র্ফাগনা ও কাশ্গড় দখল করে চীন সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু ইতিমধ্যে খলীফা আল-ওয়ালিদের মৃত্যু সংবাদ পৌছালে তার অভিযান স্থগিত হয়ে যায়।
খ. ভারত অভিযান:
সিন্ধু অভিযানের কারণসমূহ :
আল-ওয়ালিদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি:
মধ্যযুগের সকল শাসকের ন্যায় আল-ওয়ালিদ সিংহাসনে বসেই সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর রাজ্য বিস্তারের অংশ হিসেবে সিন্ধুতে অভিযান প্রেরণের নির্দেশ দেন।
ভারতের ঐশ্বর্য:
সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবষর্ ধন-সম্পদে ঐশ্বর্যশালী। উপকূলীয় বাণিজ্য এই উপমহাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই অর্থনৈতিক কারণেও এই অভিযান প্রেরিত হয়। এছাড়া কাবুল ও কান্দাহারের ভারতীয় রাজাগণ মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন।
দাহির কর্তৃক বিদ্রোহীদের আশ্রয়দান:
আরব বিদ্রোহীগণ, বিশেষ করে হাজ্জজ বিন ইউসুফের অধীনে ইরাকের বিদ্রোহীগণ পালিয়ে সিন্ধু প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ রাজা দাহিরকে তাদের ফিরিয়ে দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। রাজা দাহির তা করতে অস্বীকার করেন।
আরব জাহাজ লুন্ঠন:
সিংহলের রাজা কর্তৃক খলীফা আল-ওয়ালিদ ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্য প্রেরিত উপহার, উপঢৌকন সম্বলিত ৮ টি জাহাজ সিন্ধুর দেবল বন্দরে জলদস্যু কর্তৃক লুন্ঠিত হলে হাজ্জাজ এর ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু রাজা দাহির এই দায় অস্বীকার করেন। এই সমস্ত কারণে সিন্ধুতে অভিযান প্রেরিত হয়।
সিন্ধু অভিযানের ঘটনাপ্রবাহ
তুর্কিদের পূর্বেই সিন্ধু বা ভারতীয় উপমহাদেশ আরবদের পদানত হয়েছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন খলীফার পূবার্ঞ্চলের শাসনকর্তা। তিনি খলীফার প্রতিনিধি হয়ে সিন্ধুতে অভিযান প্রেরণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে উবায়দুল্লাহ ও বুদায়েলের নেতৃত্বে প্রেরিত অভিযান ২টি ব্যর্থ হয়। অবশেষে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জামাতা ও ভ্রাতষ্পুত্র মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক পরিচালিত অভিযানটি সফল হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১০-৭১২ খ্রী. সিন্ধু অভিযানটি পরিচালিত করেন। এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে ৬০০০ উষ্ট্রারোহী, ৬০০০ সিরীয় অশ্বারোহী এবং ২০০০ ভারবাহী পশু। মুহাম্মদ বিন কাসিম বর্তমান পাকিস্তানের মাকরান প্রদেশ দিয়ে দেবলের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মাকরানের শাসক হারুন তাকে সৈন্যসামন্ত ও প্রয়োজনীয় সাহায্য করেন। দাহিরের কুশাসনে বহু নিম্ন হিন্দুজাত যেমন জাট ও মেঠ স্বেচ্ছায় মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রথমে দেবলের শাসক রাজা দাহিরের ভ্রাতুষ্পুত্রকে পরাজিত করেন এবং দেবল অধিকার করেন ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। এরপর মুহাম্মদ সিরওয়ান নামক শহরটি দখল করেন। আল-নিরুন (আধুনিক হায়দারাবাদ) সিস্তান শহর দুটি দখল করা হয়। রওয়ার নামক স্থানে রাজা দাহিরের সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। বিশাল হস্তীবাহিনী ও অশ্বারোহী বাহিনী থাকা সত্বেও এই যুদ্ধে রাজা দাহির শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। দাহির পত্নী-রানী বাঈ ১৫,০০০ সৈন্য নিয়ে আরোরা দুর্গ থেকে যুদ্ধ করেন কিন্তু‘ তিনি পরাজিত হয়ে অগ্নীকুন্ডে আত্মাহুতি দেন। এরপর মুসলমানগণ বিনা বাধায় ব্রাহ্মণাবাদ দখল করেন এবং ৭১৩ খ্রী. মুলতান অধিকৃত হয়। কিন্তু এই সময় দামেস্ক হতে খলীফার মৃত্যুর সংবাদ গিয়ে পৌছে এবং মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন।
সিন্ধু বিজয়ের ফলাফল :
রাজনৈতিক ফলাফল
ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “আরবদের সিন্ধু বিজয় প্রাক-ভারত এবং ইসলামের ইতিহাসে একটি নিষ্ফল উপাখ্যান মাত্র। লেনপুলের এই অভিমত শুধু একদিক দিয়ে সত্য। সিন্ধুতে আরবদের শাসন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এবং এ বিজয় শুধু সিন্ধু ও মুলতানে ছিল। তাই ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এ বিজয় কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
ধর্মীয় ফলাফল
ধর্মীয় দিক হতে এই অভিযানের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আরব সেনাবাহিনীর সাথে আরব বণিক ও সুফী দরবেশগণ সিন্ধু অঞ্চলে আসেন। তাঁরা ইসলাম প্রচার করেন এবং অনেকে এই অঞ্চলে বিবাহ করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের মাধ্যমেই এই অঞ্চলে ইসলাম ধমর্ প্রসার লাভ করে।
সামাজিক ফলাফল:
রাজনৈতিকভাবে এখানে মুসলমানরা টিকে না থাকলেও সামাজিকভাবে এখানে মুসলিমরা টিকে ছিল। আগত মুসলিম এবং নব-দীক্ষিত মুসলিমদের সমন্বয়ে এখানে একটি মুসলিম কমিউনিটি গড়ে ওঠে। তাদের মাধ্যমে এখানে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় যা ভবিষ্যৎ অভিযানের পথ সুগম করে। এরাই ছিল পরবর্তীতে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অগ্রপথিক।
সাংস্কৃতিক ফলাফল :
সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও এই অভিযানের সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল। আরবরা ভারতীয় গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রের সংস্পশের্ আসেন এবং গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তাই এই বিজয় সম্পূর্ণভাবে নিষ্ফল ছিল বলা যায় না।
গ.আফ্রিকা বিজয় :
হাসান বিন নুমানের মৃত্যুর পর ৭০৭ সালে মুসা ইবনে নুসাইর আফ্রিকা অঞ্চলের শাসনকর্তা নিয়োজিত হন। বার্বারগণ তাঁর পূর্ববর্তী শাসনকর্তাদের যুগে ব্যাপক বিদ্রোহ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিল। তিনি তাদেরকে পরাজিত করে আটলান্টিক সাগরে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত মুসলিম আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। বিজিত দলপতিদের প্রতি উদার মনোভাব দেখিয়ে মুসা বিন নুসাইর তাদের আস্থা অর্জন করেন। রোমানদেরকে তিনি সমগ্র উত্তর আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত করেন। বার্বার উপজাতিদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি অনেক উপদেষ্টা নিয়োগ দেন। তিনি ভূ-মধ্যসাগরে বাইজানটাইনদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং নৌ-বহরের সাহায্যে মেজর্কা, মাইনরকা, ইভিকা প্রভৃতি ভূ-মধ্যসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ দখল করেন।
ঘ.আর্মেনিয়া এশিয়া মাইনর বিজয়:
খলিফা আল-ওয়লীদের রাজত্বকালে মুসলিম সেনাবাহিনী আর্মেনিয়া ও এশিয়া মাইনরেও বিজয় অভিযান পরিচালনা করে। এসব অভিযানে নেতৃত্ব দেন খলিফার ছেলে আব্বাস এবং ভাই মাসলামা। মাসলামা অত্যন্ত দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন। তিনি ৭০৭ সালে কাপাডোসিয়ার অন্তর্গত টায়ানো দুর্গ অধিকার করেন। পরের বছর তিনি কাস্পিয়ান অঞ্চলের তুর্কিদের বিরুদ্ধেও সফল অভিযান পরিচালনা করেন। এসব অভিযানের মাধ্যমে মাসলামা এশিয়া মাইনরের একটি বিরাট অংশ মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
ঙ. স্পেন বিজয়
মুসলিম বিজয় প্রাক্কালে স্পেনের অবস্থা :
রাজনৈতিক অবস্থা :
স্পেনের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল গৃহবিবাদে পূর্ণ। উচ্চভিলাষী ও অত্যাচারী সামন্তরাজা ডিউক রডারিক স্পেনীয় সিংহাসনের রাজা উইটিজাকে পদচ্যুত ও হত্যা করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেন। তৎকালীন স্পেনে ষড়যন্ত্র, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, অত্যাচার, হত্যা , ক্যু ইত্যাদি শাসন ক্ষমতা লাভের ও শাসন পরিচালনার মাধ্যমে হিসেবে পরিণত হয়েছিল। স্পেনে তখন ছিল গথিক রাজাদের শাসন। অভিজাত শ্রেণি ছিল আপন স্বার্থসচেতন ও পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল খুবই দুর্বল। তাদের মাঝে কোন ঐক্য ছিল না। কেন্দ্রের সাথে প্রদেশের সম্পর্ক ছিল খুবই দুর্বল। রাজ্যগুলো প্রায় স্বাধীনভাবে চলত এবং এক রাজ্য সব সময় অন্য রাজ্য দখলের চেষ্টায় লিপ্ত থাকতো।
সামাজিক অবস্থা :
সমাজব্যবস্থা ছিল ৩টি পধান শ্রেণীতে বিভক্ত। যেমন-
আভিজাত্য সম্প্রদায় :
রাজা ও তার শাসনকার্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, গীর্জার পাদ্রি ও সামন্তরাজাগণ। এদের কোন প্রকার কর দিতে হতো না। কিন্তু যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তারাই ভোগ করত এবং সমাজের নেতা ও তারাই ছিল। তারা আড়ম্বরপূর্ণ জীবন যাপন করত।
মধ্যবিত্ত শ্রেনী:
এরা সমাজের মধ্যভাগে অবস্থান করতো। তাদেরকে সকল প্রকার করা প্রদানে বাধ্য করা হতো। এরা ছিল ঋণগ্রস্থ ও হতাশ। রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় ব্যয়ভার বলতে গেলে তারাই বহন করত।
নিম্ন শ্রেনী:
কৃষক এবং ক্রীতদাসরা ছিলেন তৃতীয় শ্রেণীর। কৃষকরা মূলত ছিল ভূমিদাস আর অন্যরা ছিল ব্যক্তিগত ক্রীতদাস। যাদের কোন স্বাধীনতা ছিল না। তাদের-কে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হত না। কৃষকদের জমির মালিকানা ছিল না বরং তাদের ভাগ্য নির্ধারিত থাকতো ভূস্বামীদের সাথে। জমির মালিকানার পরিবর্তন ঘটলে কৃষকের মালিকানার পরিবর্তন ঘটতো। ক্রীতদাসরা পশুর মত হাটে বাজারে বিক্রি হত। সমাজে খ্রিস্টানদের দ্বারা ইহুদিরা বেশি নিষ্পেষিত হইতেছিল।
ধর্মীয় অবস্থা :
সমাজে কোন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল না। ইহুদীরা ছিল নির্যাতিত। তাদের ধর্মীয় কোন স্বাধীনতা ছিল না। চার্চের প্রাধান্য ছিল সবকিছুর উর্ধ্বে। খ্রিস্টান ধর্ম ব্যতীত অন্য ধর্মচর্চায় নিষেধাজ্ঞা ছিল। অন্য ধর্মের লোকেরা হয় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হতো অথবা সেবাদাস হিসেবে জীবন যাপন করতে হতো। অন্য ধর্মের লোকদের খ্রিস্টান দাস-দাসীদের সাথে বাধ্যতামূলক বিয়ে দেয়া হতো। এই পরিস্থিতিতে ইহুদীরা একবার বিদ্রোহ করলে তাদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। বিদ্রোহীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে দাসত্বের পরিণত করা হয় এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়।
অর্থনৈতিক অবস্থা:
মুসলমানদের স্পেন অভিযানের প্রাক্কালে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বৈষম্যপূর্ণ। একদিকে অভিজাতগণ বিলাসবহুল জীবন যাপন করত অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা অভাবগ্রস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত জীবনযাপন করত। কলকারখানায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং ইহুদিরা বেশি সংশ্লিষ্ট ছিল। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা অন্যদিকে ইহুদিদের প্রতি নিপীড়নের কারণে কলকারখানায় উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
স্পেন বিজয়ের কারণসমূহ :
স্পেনীয়দের আমন্ত্রন:
স্পেনের গথিক রাজার দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই উত্তর আফ্রিকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা মুসলমানদের জীবনাচরণ, ধর্ম, মূল্যবোধ, লেনদেন, সাম্যবাদ, ইবাদত বন্দেগী ইত্যাদি নানা বিষয় দেখে দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়। এই সকল ক্রীতদাস, ভূমিদাস এবং অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিত ইহুদী সম্প্রদায় উত্তর আফ্রিকায় অবস্থানরত মুসা বিন নুসাইরকে স্পেন অভিযানে আহবান ও অনুপ্রাণিত করে।
সাম্রাজ্যবাদী নীতি
অপর দিকে স্পেন বিজয় ছিল খলীফা আল-ওয়ালিদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির একটি অংশ। মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তার এবং ইসলামের বিস্তার ঘটানো এই অভিযানের অন্যতম কারণ।
কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রন ও সহযোগীতা:
সিউটার শাসনকর্তা কাউন্ট জুলিয়ান ছিল মৃত ও সিংহাসনচ্যুত রাজা উইটজার জামাতা। কাউন্ট জুলিয়ান তাই স্পেনের সিংহাসনকে শত্রুমুক্ত করতে চেয়েছিলো এবং মুসা ইবনে নুসাইরকে স্পেনে আহবান করেন। এই অভিযানে কাউন্ট জুলিয়ান মুসলিম সেনাবাহনীকে সর্বাত্মক সাহায্য করেন। যুদ্ধ জাহাজ, প্রয়োজনীয় রসদ ও সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে তিনি মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করেন। কাউন্ট জুলিয়ানের সর্বাত্মক সহযোগিতার পেছনে রয়েছে তার কন্যা ফ্লোরিন্ডাকে রডারিক কর্তৃক অবমাননা। তাই এই অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কাউন্ট জুলিয়ান মুসা ইবনে নুসাইরকে স্পেন বিজয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
স্পেন বিজয়ের ঘটনা প্রবাহ :
মুসা ইবনে নুসাইর প্রথমে তার অনুচর তারিককে স্পেনে প্রেরণ করেন। তারিফ ফিরে এসে তাঁকে আক্রমণের অনুকূল পরিবেশের কথা ব্যক্ত করেন। এরপর মুসা আর একজন বিশ্বস্ত অনুচর ও সেনাপতি বার্বার যোদ্ধা তারিক বিন যিয়াদকে ৭১১ খি: স্পেন অভিযানে প্রেরণ করেন। এই সময় ৭০০০ সৈন্য নিয়ে তারিক যে পাহাড়ে অবতরণ করেন তা ‘জাবাল আল তারিক’ (তারিকের পাহাড়) নামে পরিচিত হয়। ইউরোপীয়দের নিকট এটি জিব্রালটার নামে পরিচিত। ৭১২ খ্রী. মেডিনা-সিডোনিয়া নামক স্থানে গোয়াদালকুইভার নামক নদীর তীরে তারিক রডারিকের বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অবতীণর্ হন। এই সময় মুসা ইবনে নুসাইর ৫০০০ সৈন্য সাহায্য পাঠালে তারিকের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১২,০০০ এবং রডারিকের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০,০০০। যুদ্ধে রডারিক পরাজিত হন এবং পলায়নকালে গোয়া ডিলেট নদীতে নিমজ্জিত হয়ে মারা যান। মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করলো। তারিক তাঁর সেনাবাহিনীকে চারভাগে বিভক্ত করে যথাক্রমে মালাগা, গ্রানাডা,কর্ডোভায় পাঠালেন এবং নিজে রাজধানী টলেডো দখল করলেন। তারিকের সাফল্যে অনুপ্রাণীত হয়ে মুসা বিন নুসাইর ৭১২ খ্রী. ভীন্ন পথ ধরে স্পেন আগমন করেন এবং সেভিল, মেরিডা, কারমোনা প্রভৃতি শহর জয় করে টলেডোর নিকট তারিকের সাথে মিলিত হন। অতপর তাদের মিলিত বাহিনী সারাগোসা, টেরাগোনা, আরাগোনা, বার্সালোনা, লিও প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে। এই সময়ে খলীফা আল-ওয়ালিদের মৃত্যুসংবাদ তাদের নিকট পৌছালে তারা দামেস্ক অভিমুখে যাত্রা করেন।
স্পেন বিজয়ের ফলাফল :
সাম্য ও ন্যায়নীতির প্রবর্তন:
আরবদের কর্তৃক স্পেন বিজয় ইউরোপীয় ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। অত্যাচার-অবিচারের পরিবতের্ সমাজে সাম্য ও ন্যায়বচিার প্রতিষ্ঠিত হয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতা:
আরবদের কর্তৃক স্পেন বিজয়ের ফলে সেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদী ও খ্রিস্টানগণ স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বীকৃত হয়। ধর্মীয় ক্ষেত্রে সকল অনাচার -অবিচার সমাজ হতে তিরোহিত করা হয়।
দাসদের মর্যাদা:
সমাজে দাস ও ভূমিদাসগণ স্বাধীনভাবে বসবাস করার সুযোগ পায়। সামাজিকভাবে জীবনযাপন করার সুযোগ পায়। অত্যাচারের অবসান ঘটে।
যাজক শ্রেণির ক্ষমতা হ্রাস:
সমাজের উচ্চ ও অভিজাত শ্রেনীর বিশেষ করে যাজক শ্রেণির ক্ষমতার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়। মুসলিম বিজয়ের পর যাজক শ্রেণির শোষণের হাত থেকে স্পেনীয়রা মুক্তি পায়।
কৃষি ও ব্যবসায় বাণিজ্য:
মুসলমানগণ স্পেন বিজয়ের পর সেখানকার কৃষি ও ব্যবসায় বাণিজ্যে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন এবং এই ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয়।
মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা:
স্পেন বিজয়ের পর সেখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসা ইবনে নুসাইর তাঁর পুত্র আব্দুল আযিযকে স্পেনের, আব্দুল্লাহকে ইফ্রিকিয়ার ও আব্দুল মালিককে মরক্কোর শাসনকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন।
শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞান:
মুসলমান কর্তৃক স্পেন বিজয়ের ফলে এখানে শিল্প, সাহিত্যের ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিচর্চা ও বিকাশ ঘটে। শিক্ষা, সংস্কৃতি গবেষণার ক্ষেত্রে গোটা ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
আল ওয়ালিদের মৃত্যু
খলীফা আল ওয়ালিদ ১০ বছর গৌরবের সাথে রাজত ¡ করার পর ৭১৫ খ্রি: মৃত্যুবরণ করে। তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর পুত্রকে উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করেন কিন্ত তাঁর পুত্র তার জীবদ্দশায় মারা যান। তাই তাঁর ভ্রাতা সুলায়মান তার মৃত্যুর পর দামেস্কের সিংহাসন আরোহণ করেন।
চরিত্র ও কৃতিত্ব :
দয়ালু ও সুযোগ্য শাসক:
সৈয়দ আমীর আলী বলেন- তিনি যে তার পিতা আব্দুল মালিক ও পিতামহ মারওয়ান অপেক্ষা দয়ালু ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং এটা নিশ্চিত যে, তার বংশধরগণের অনেকের চেয়ে তিনি হৃদয়বান ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকগণ তাঁকে স্বেচ্ছাচারি বললেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন দয়ালু ও একজন সুযোগ্য শাসক।
উমাইয়া ইতিহাসের স্বর্ণ যুগ:
আল-ওয়ালিদ ছিলেন উমাইয়া বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা যার রাজত্বকাল ইতিহাসে ¯ণ্বর্ যুগ হিসেবে খ্যাত। তিনি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করেন।
সর্বশ্রেষ্ঠ বিজেতা:
আল-ওয়ালিদ কেবল উমাইয়া বংশেরই নন সমগ ্র মুসলিমদের ইতিহাসে অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ বিজেতা। তিনি অক্সাস নদী হতে সিন্ধু নদ, উত্তর আফ্রিকা হতে স্পেন পর্যন্ত তার সা¤্রাজ্য বিস্তার করেন। তিনি বিশাল সাম্রাজ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সমসাময়কি রাজণ্যবর্গের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।
জনহিতকর কার্যাবলী:
তিনি সাম্রাজ্যের সর্বত্র রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং কূপ খনন করেন। সীমান্ত রক্ষার জন্য দূর্গ নির্মাণ করেন । বিদ্যালয় ও হাসপাতাল নির্মাণ করেন। দুস্থদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করেন। তিনি অসহায় ও দুস্থদের রাষ্ট্র হতে ভাতা প্রদান করতেন। অসহায়, পঙ্গু, অন্ধ, পাগল, ও অক্ষম লোকদের জন্য তিনি আহার, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এতিম বালক বালিকার জন্য এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
স্থাপত্যবিদ্যা:
আল-ওয়ালিদ ছিলেন যুগের একজন শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যবিদ। দামেস্কের জামে মসজিদ তার স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নির্দশন। এছাড়াও তিনি মক্কা ও মদীনায় মসজিদ সংষ্কার করেন যে শহরে মসজিদ ছিল না সেখানে মসজিদ নিমার্ণ করেন।
শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক
আল-ওয়ালিদ শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর দরবারে কবি ও সাহিত্যিকদের বিশেষ সমাদার করা হতো। কবি ফারায্দাক তার দরবার অলংকৃত করেন। খলীফা নিজে ছিলেন কবি ও সঙ্গীতানুরাগী। তাঁর সময়ে কুফায় ও বসরায় জ্ঞান বিজ্ঞান ও হাদীস চর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর সময়ে মক্কায় কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
নৌ-বহরের উন্নতি:
আল-ওয়ালিদ ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ সামরিক সংগঠক। তিনি নৌ-বহরের উন্নতি সাধন করেন যা মাধ্যমে ভূ-মধ্যসাগরে রোমানদের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করেছিলেন।
আল-ওয়ালিদ আব্দুল মালিকের একজন যোগ্যতম উত্তরসূরি এবং উমাইয়া বংশের একজন শ্রেষ্ঠতম শাসক। তাঁর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়। তিনি উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, সিন্ধু ও মধ্য এশিয়ায় ইসলামী পতাকা উত্তোলন করেন। শ্রেষ্ঠতম সেনাপতিগণ ছিলেন তার সাফল্যের কারিগর। স্থাপত্য ও প্রশাসনে তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির নৃপতি। তাই তিনি শুধু উমাইয়া বংশের নয় তিনি ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ নৃপতি ও বিজেতা।
আরও পড়ুন-
বিদায় হজ্বের ভাষণ এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কর্তৃক ঘোষিত সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কারাবলী
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর নবুওয়াত লাভ এবং ঘটনাবহুল মক্কী জীবন
আরও পড়ুন-
খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ।। ইসলামের পঞ্চম খলিফা
আরও পড়ুন-
আরও পড়ুন-
মুহাম্মদ (স.) এর হিজরত: কারণ ও ফলাফল
আরও পড়ুন-
হযরত উসমান (রা.) এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ পর্যালোচনা
আরও পড়ুন-
রিদ্দার যুদ্ধঃ কারণ ঘটনা ও ফলাফল
গ্রন্থপঞ্জি:
P.K, Hitti, History of the Arabs, third edition revised, Macmillan and Company Limited, London,1946,
Sayed Amir Ali, A Short History of the Saracens, Macmillan and Company Limited, London, 1916
S.W, Muir, The Caliphate, its Rise, Decline & Fall, The Religious Tract Society, Piccadilly, London. 1891
পি,কে হিট্টি, আরর জাতির ইতিহাস , (বাংলা অনুবাদ)
সৈয়দ আমীর আলী, আরব জাতির ইতিহাস, (বাংলা অনুবাদ)
প্রফেসর ড. মো আতিয়ার রহমান ও ড. মো. ইব্রাহীম খলিল,মুসলমানদের ইতিহাস (৫৭০-৭৫০)
মোহা. আল মুস্তানছির বিল্যাহ, ইসলামের ইতিহাস: হযরত মুহাম্মদ (সা.), খোলাফায়ে রািশেদিন ও উমাইয়া খিলাফত
মাহবুবুর রহমান,মুসলমানদের ইতিহাস (570-1517), বুকস ফেয়ার, ঢাকা, 2015
http://www.ebookbou.edu.bd/Books/Text/OS/HSC/hsc_1856/Unit-06.pdf
Md. Billal Hossain
B.A. Honors (1st Class 4th), M.A. (1st Class 2nd), University of Dhaka
BCS General Education
Lecturer
Department of Islamic History & Culture
Chandpur Govt. College, Chandpur.
No comments:
Post a Comment